ঘণ্টা-দুই পরে তাহাকে ফুল ও চন্দনে সজ্জিত করিয়া নলিনী বধূর আসনে বসাইয়া সম্মুখে বড় জানালাটা খুলিয়া দিতেই তাহার লজ্জিত মুখের উপর দক্ষিণের বাতাস এবং আকাশের জ্যোৎস্না যেন একই কালে তাহার স্বর্গত মাতা-পিতার আশীর্বাদের মত আসিয়া পড়িল।
যিনি সম্প্রদান করিতে বসিলেন, শোনা গেল, তিনি কোন্ এক সুদূর-সম্পর্কে বিজয়ার পিসী। একচক্ষু ভট্টাচার্যমশাই মন্ত্র পড়াইতে বসিয়া দাবী করিলেন, দুই-তিন পুরুষ পূর্বে তাঁরাই ছিলেন জমিদার-বাটীর কুল-পুরোহিত।
বিবাহ অনুষ্ঠান সমাধা হইয়া গিয়াছে—বর-বধূকে তুলিবার আয়োজন হইতেছে, এমন সময়ে রাসবিহারী আসিয়া বিবাহ-সভায় উপস্থিত হইলেন। দয়াল উঠিয়া দাঁড়াইয়া সসম্মানে অভ্যর্থনা করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন, এস ভাই, এস। শুভকর্ম নির্বিঘ্নে শেষ হয়ে গিয়েছে—আজকের দিনে আর মনের মধ্যে কোন গ্লানি রেখো না ভাই—এদের তুমি আশীর্বাদ কর।
রাসবিহারী ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া সহজ গলায় কহিলেন, বনমালীর মেয়ের বিবাহটা কি শেষে হিঁদুর মতেই দিলে দয়াল? আমাকে একটু জানালে ত এর প্রয়োজন হত না।
দয়াল থতমত খাইয়া কহিল, সমস্ত বিবাহই ত এক ভাই।
রাসবিহারী কঠোরস্বরে কহিলেন, না। কিন্তু বনমালীর মেয়ে কি তার বাপের গ্রাম থেকে আজীবন নির্বাসন-দুঃখও একবার ভেবে দেখলে না?
নলিনী পাশেই দাঁড়াইয়া ছিল—সে কহিল, তাঁর মেয়ে তার স্বর্গীয় পিতার সত্যকার আজ্ঞাটাই পালন করছে, অনুষ্ঠানের কথা ভাববার সময় পায়নি। আপনি নিজেও ত বনমালীবাবুর যথার্থ ইচ্ছাটা জানতেন। তাতে ত ত্রুটি হয়নি।
রাসবিহারী এই দুর্মুখ মেয়েটার প্রতি একটা ক্রুর দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া শুধু বলিলেন, হুঁ। বলিয়া ফিরিতে উদ্যত হইতেছিলেন—নলিনী আবদারের সুরে কহিল, বাঃ—আপনি বুঝি বিয়ে-বাড়ি থেকে শুধু শুধু চলে যাবেন? সে হবে না, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে! আমি মামাকে দিয়ে কত কষ্ট করে আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনিয়েছি।
রাসবিহারী কথা কহিলেন না, শুধু আর একটা অগ্নিদৃষ্টি তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।