এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  দত্তা         
পরিচ্ছেদ: / 26
পৃষ্ঠা: / 132
দত্তা

প্রথম পরিচ্ছেদ

সেকালে হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের হেডমাস্টারবাবু বিদ্যালয়ের রত্ন বলিয়া যে তিনটি ছেলেকে নির্দেশ করিতেন, তাহারা তিনখানি বিভিন্ন গ্রাম হইতে প্রত্যহ এক ক্রোশ পথ হাঁটিয়া পড়িতে আসিত। তিনজনের কি ভালবাসাই ছিল! এমন দিন ছিল না, যেদিন এই তিনটি বন্ধুতে স্কুলের পথে ন্যাড়া বটতলায় একত্র না হইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিত! তিন জনেরই বাড়ি ছিল হুগলির পশ্চিমে। জগদীশ আসিত সরস্বতীর পুল পার হইয়া দিঘ্‌ড়া গ্রাম হইতে, এবং বনমালী ও রাসবিহারী আসিত দুইখানি পাশাপাশি গ্রাম কৃষ্ণপুর ও রাধাপুর হইতে। জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবচেয়ে মন্দ। পিতা একজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত। যজমানি করিয়া বিয়া-পৈতা দিয়াই সংসার চালাইতেন। বনমালীরা সঙ্গতিপন্ন জমিদার। তাহার পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়াই জানিত, অথচ পল্লীগ্রামের সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন। রাসবিহারীদের অবস্থাও বেশ সচ্ছল। জমিজমা চাষবাস পুকুর-বাগান,—পাড়াগাঁয়ে যাহা থাকিলে সংসার চলিয়া যায়—সবই ছিল। এ সকল থাকা সত্ত্বেও যে ছেলেরা কোন শহরে বাসা ভাড়া না করিয়া—ঝড় নাই, জল নাই, শীত-গ্রীষ্ম মাথায় পাতিয়া এতটা পথ হাঁটিয়া প্রত্যহ বাটী হইতে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করিত, তাহার কারণ, তখনকার দিনে কোন পিতামাতাই ছেলেদের এই ক্লেশ-স্বীকার করাটাকে ক্লেশ বলিয়াই ভাবিতে পারিতেন না; বরঞ্চ মনে করিতেন, এতটুকু দুঃখ না করিলে সরস্বতী ধরা দিবেন না। তা কারণ যাই হোক; এমনি করিয়াই ছেলে তিনটি এন্ট্রাস পাশ করিয়াছিল। বটতলায় বসিয়া ন্যাড়া বটকে সাক্ষী করিয়া তিন বন্ধুতে প্রতিদিন এই প্রতিজ্ঞা করিত, জীবনে কখনও তাহারা পৃথক হইবে না, কখনও বিবাহ করিবে না, এবং উকিল হইয়া তিনজনেই একটা বাড়িতে থাকিবে; টাকা রোজগার করিয়া সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে জমা করিবে, এবং তাই দিয়া দেশের কাজ করিবে।

এই ত গেল ছেলেবেলার কল্পনা। কিন্তু যেটা কল্পনা নয়, সত্য, সেটা অবশেষে কিরূপ দাঁড়াইল, তাহাই সংক্ষেপে বলিতেছি। বন্ধুত্বের প্রথম পাক্‌‌টা এলাইয়া গেল বি. এ. ক্লাসে। কলিকাতায় কেশব সেনের তখন প্রচণ্ড প্রতাপ। বক্তৃতার বড় জোর। সে জোর পাড়াগাঁয়ের ছেলে-তিনটি হঠাৎ সামলাইতে পারিল না—ভাসিয়া গেল! গেল বটে, কিন্তু বনমালী এবং রাসবিহারী যেরূপ প্রকাশ্যে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইল, জগদীশ সেরূপ পারিল না—ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। সে সর্বাপেক্ষা মেধাবী বটে, কিন্তু অত্যন্ত দুর্বলচিত্ত। তাহাতে তাহার ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত পিতা তখনও জীবিত ছিলেন। কিন্তু ও দুটির সে বালাই ছিল না। কিছুকাল পূর্বে পিতার পরলোক প্রাপ্তিতে বনমালী তখন কৃষ্ণপুরের জমিদার, এবং রাসবিহারী তাহাদের রাধাপুরের সমস্ত বিষয়-আশয়ের একচ্ছত্র সম্রাট।