অতএব অনতিকাল পরেই এই দুই বন্ধু ব্রাহ্ম-পরিবারে বিবাহ করিয়া বিদুষী ভার্যা লইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু দরিদ্র জগদীশের সে সুবিধা হইল না। তাহাকে যথাসময়ে আইন পাশ করিতে হইল, এবং এক গৃহস্থ ব্রাহ্মণের এগারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করিয়া অর্থোপার্জনের নিমিত্ত এলাহাবাদে চলিয়া যাইতে হইল। কিন্তু যাঁহারা রহিলেন, তাঁহাদের যে কাজ কলিকাতায় নিতান্ত সহজ মনে হইয়াছিল, গ্রামে ফিরিয়া তাহাই একান্ত কঠিন ঠেকিল। বৌ-মানুষ শ্বশুরবাড়ি আসিয়া ঘোমটা দেয় না, জুতামোজা পরিয়া রাস্তায় বাহির হয়—তামাশা দেখিতে পাঁচখানা গ্রামের লোক ভিড় করিয়া আসিতে লাগিল; এবং গ্রাম জুড়িয়া এমনি একটা কদর্য হৈ হৈ শুরু হইয়া গেল যে, একান্ত নিরুপায় না হইলে আর কেহ স্ত্রী লইয়া সেখানে বাস করিতে পারে না। বনমালীর উপায় ছিল, সুতরাং সে গ্রাম ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়া বাস করিল; এবং একমাত্র জমিদারির উপর নির্ভর না করিয়া ব্যবসা শুরু করিয়া দিল। কিন্তু রাসবিহারীর অল্প আয়। কাজেই সে নিজের পিঠের উপর একটা এবং বিদুষী ভার্যার পিঠের উপর একটা কুলা চাপা দিয়া কোনমতে তাহার দেশের বাটীতেই 'একঘরে' হইয়া বসিয়া রহিল। অতএব এই তিন বন্ধুর একজন এলাহাবাদে, একজন রাধাপুরে এবং আর একজন কলিকাতায় বাসা করায়, আজীবন অবিবাহিত থাকিয়া, এক বাড়িতে বাস করিয়া, এক সিন্দুকে টাকা জমা করিয়া দেশ উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞাটা আপাততঃ স্থগিত রহিল; এবং যে ন্যাড়া বটবৃক্ষ সাক্ষ্য ছিলেন, তিনি কাহারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন না করিয়া নীরবে মনে মনে বোধ করি হাসিতে লাগিলেন। এইভাবে অনেক দিন গেল। ইতিমধ্যে তিন বন্ধুর কদাচিৎ কখনও দেখা হইত বটে, কিন্তু ছেলেবেলার প্রণয়টা একেবারে তিরোহিত হইল না। জগদীশের ছেলে হইলে সে বনমালীকে সুসংবাদ দিয়া এলাহাবাদ হইতে লিখিল, ‘তোমার মেয়ে হইলে তাহাকে পুত্রবধূ করিয়া, ছেলেবেলায় যে পাপ করিয়াছি, তাহার কতক প্রায়শ্চিত্ত করিব। তোমার দয়াতেই আমি উকিল হইয়া সুখে আছি, এ-কথা কোন দিন ভুলি নাই।
বনমালী তাহার উত্তরে লিখিলেন, 'বেশ। তোমার ছেলের দীর্ঘজীবন কামনা করি। কিন্তু আমার মেয়ে হওয়ার কোন আশাই নাই। তবে, যদি কোন দিন মঙ্গলময়ের আশীর্বাদে সন্তান হয়, তোমাকে দিব। চিঠি লিখিয়া বনমালী মনে মনে হাসিল। কারণ বছর-দুই পূর্বে তাহার অপর বন্ধু রাসবিহারীর যখন ছেলে হয়, সেও ঠিক এই প্রার্থনাই করিয়া ছিল। বাণিজ্যের কৃপায় সে এখন মস্ত ধনী। সবাই তাহার মেয়েকে ঘরে আনিতে চায়।