এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  দত্তা         
পরিচ্ছেদ: / 26
পৃষ্ঠা: / 132
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দু'মাস-ছ'মাসের কথা নয়, পঁচিশ বৎসরের কাহিনী বলিতেছি। বনমালী প্রাচীন হইয়াছেন। কয়েক বৎসর হইতে রোগে ভুগিয়া ভুগিয়া এইবার শয্যা আশ্রয় করিয়া টের পাইয়াছিলেন, আর বোধ হয় উঠিতে হইবে না। তিনি চিরদিনই ভগবৎপরায়ণ ও ধর্মভীরু। মরণে তাঁহার ভয় ছিল না, শুধু একমাত্র সন্তান বিজয়ার বিবাহ দিয়া যাইবার অবকাশ ঘটিল না মনে করিয়াই কিছু ক্ষুণ্ণ ছিলেন। সেদিন অপরাহ্নকালে হঠাৎ বিজয়ার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া বলিয়াছিলেন, মা, আমার ছেলে নেই বলে আমি এতটুকু দুঃখ করিনে। তুই আমার সব। এখনো তোর আঠারো বৎসর বয়স পূর্ণ হয়নি বটে, কিন্তু তোর এইটুকু মাথার উপর আমার এত বড় বিষয়টা রেখে যেতেও আমার একবিন্দু ভয় হয় না। তোর মা নেই, ভাই নেই, একটা খুড়ো-জ্যাঠা পর্যন্ত নেই। তবু আমি নিশ্চয় জানি, আমার সমস্ত বজায় থাকবে। শুধু একটা অনুরোধ করে যাই মা, জগদীশ যাই করুক, আর যাই হোক, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তাকে ভালবাসি—এই কথাটা ভুলিস নে মা। তার একটি ছেলে আছে—তাকে চোখে দেখিনি, কিন্তু শুনেছি সে বড় সৎ ছেলে। বাপের দোষে সে যেন না দণ্ড ভোগ করে, এই আমার অনুরোধ।

বিজয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কহিয়াছিল, বাবা, তোমার আদেশ আমি কোন দিন অমান্য করব না। জগদীশবাবু যতদিন বাঁচবেন, তাঁকে তোমার মতই মান্য করব; কিন্তু তাঁর অবর্তমানে, সমস্ত বিষয় মিছামিছি তাঁর ছেলেকে কেন ছেড়ে দেব? তাঁকে তুমিও কখনো চোখে দেখনি, আমিও দেখিনি। আর যদি সত্যিই তিনি লেখাপড়া শিখে থাকেন, অনায়াসেই ত পিতৃ-ঋণ শোধ করতে পারবেন।

বনমালী মেয়ের মুখের পানে চোখ তুলিয়া কহিয়াছিলেন, ঋণ ত কম নয় মা! ছেলেমানুষ, এ যদি না শুধতে পারে?

মেয়ে জবাব দিয়াছিল, যে না পারে, সে কুসন্তান বাবা, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

বনমালী তাঁহার এই সুশিক্ষিতা তেজস্বিনী কন্যাকে চিনিতেন। তাই আর পীড়াপীড়ি করেন নাই; শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন, সমস্ত কাজকর্মে ভগবানকে মাথার উপর রেখে যা কর্তব্য, তাই করো মা। তোমাকে বিশেষ কোন আদেশ দিয়ে আমি আবদ্ধ করে যেতে চাইনে। বলিয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিয়াছিলেন, জানিস মা বিজয়া, এই জগদীশ যখন একটা মানুষের মত মানুষ ছিল, তখন তুই না জন্মাতেই সে তোকে তার এই ছেলেটির নাম কোরে চেয়ে নিয়েছিল। আমিও মা, কথা দিয়েছিলাম; বলিয়া তিনি যেন উৎসুক দৃষ্টিতেই চাহিয়াছিলেন।