এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  দত্তা         
পরিচ্ছেদ: / 26
পৃষ্ঠা: / 132
তাঁহার এই কন্যাটি শিশুকালেই মাতৃহীন হইয়াছিল বলিয়া তিনিই তাহার পিতামাতা উভয়ের স্থান পূর্ণ করিয়াছিলেন। তাই বিজয়া পিতার কাছে মায়ের আবদার করিতেও কোন দিন সঙ্কোচ বোধ করে নাই; কহিয়াছিল, বাবা, তুমি তাঁকে শুধু মুখের কথাই দিয়েছিলে, তোমার মনের কথা দাওনি।

কেন মা?

তা দিলে কি একবার তাঁকে চোখের দেখা দেখতেও চাইতে না?

বনমালী বলিয়াছিলেন, রাসবিহারীর কাছে যখন শুনেছিলাম, ছেলেটি নাকি তার মায়ের মতই দুর্বল—এমন কি, ডাক্তারেরা তার দীর্ঘজীবনের কোন আশাই করেন না, তখন তাকে কাছে পেয়েও একবার আনিয়ে দেখতে চাইনি। এই কলকাতা শহরেই কোন্‌ একটা বাসায় থেকে সে তখন বি. এ. পড়ত। তার পরে নিজের নানান অসুখে-বিসুখে সে কথা আর ভাবিনি। কিন্তু এখন দেখছি, সেটাই আমার মস্ত ক্ষতি হয়ে গেছে মা। তবু, তোকে সত্য বলছি বিজয়া, সে-সময় জগদীশকে তোর সম্বন্ধে আমার মনের কথাই দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিয়াছিলেন, আজ জগদীশকে সবাই জানে—একটা অকর্মণ্য জুয়াড়ি, অপদার্থ মাতাল। কিন্তু এই জগদীশই একদিন আমাদের সকলের চেয়ে ভাল ছেলে ছিল। বিদ্যাবুদ্ধির জন্য বলছি না, মা, সে অনেকেরই থাকে; কিন্তু এমন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে আমি কাউকে দেখিনি; এই ভালবাসাই তার কাল হয়েছে। তার অনেক দোষ আমি জানি, কিন্তু যখনি মনে পড়ে, স্ত্রীর মৃত্যুতে সে শোকে পাগল হয়ে গেছে, তখন তোর মায়ের কথা স্মরণ করে আমি ত মা তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা না করে পারিনে। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সতীলক্ষ্মী। তিনি মৃত্যুকালে নরেনকে কাছে ডেকে শুধু বলেছিলেন, বাবা, শুধু এই আশীর্বাদই করে যাই, যেন ভগবানের ওপর তোমার অচল বিশ্বাস থাকে। শুনেছি নাকি মায়ের এই শেষ আশীর্বাদটুকু নিষ্ফল হয়নি। নরেন এইটুকু বয়সেই ভগবানকে তার মায়ের মতই ভালবাসতে শিখেছে। যে এ পেরেছে, সংসারে আর তার বাকী কি আছে মা?

বিজয়া প্রশ্ন করিয়াছিল, এইটাই কি সংসারে সব চেয়ে বড় পারা বাবা?

মরণ প্রতীক্ষায় বনমালীর দিন কাটিতেছিল, কন্যার প্রশ্নে তাঁহার শুষ্ক চক্ষু সজল হইয়া উঠিয়াছিল। দুই হাত বাড়াইয়া মেয়েকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া বলিয়াছিলেন, এইটিই সব চেয়ে বড় পারা মা! সংসারের মধ্যে, সংসারের বাইরে—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এত বড় পারা আর কিছু নেই বিজয়া। তুমি নিজে কোন দিন পারো আর না পারো, এ যে পারে, তার পায়ে যেন মাথা পাততে পারো—আমিও মরণকালে তোমাকে এই আশীর্বাদ করে যাই।