একটুখানি পথ আসিয়া দেখিতে পাইল, জন-কয়েক লোক লুচি, মাছের তরকারি ও বিবিধ মিষ্টান্নের ভূয়সী প্রশংসায় সমস্ত রাস্তাটা মুখরিত করিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে ঘরে চলিয়াছে। তাহাদের আনন্দ ও পরিতৃপ্তি ধরে না। জ্যোৎস্নার আলোকে পাছে ইহারা চিনিয়া ফেলে এই ভয়ে সন্ধ্যা পিতার হাত ধরিয়া পথের ধার ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল এবং তাহারা চলিয়া গেলে আবার পথ চলিতে লাগিল।
মোড় ফিরিয়াই ইহাদের ভুরিভোজনের হেতু বুঝা গেল। পার্শ্বের আমবাগানের ভিতর দিয়া গোলোক চাটুয্যে মহাশয়ের বাটী হইতে প্রচুর আলোক এবং প্রচুরতম কলরব আসিতেছে। লুচি আনো, তরকারি এইদিকে, দই কে দিচ্চে, মিষ্টি কই—প্রভৃতি বহুকণ্ঠনিঃসৃত শব্দে সমস্ত স্থানটা জমজম করিতেছে।
প্রিয় কহিলেন, গোলোক চাটুয্যেমশায়ের আজ বৌভাত কিনা! কাজেকর্মে চাটুয্যেমশাই খাওয়ায় ভাল। শুনলাম পাঁচখানা গ্রাম বলা হয়েছে—বামুন-শূদ্দুর কেউ বাদ পড়েনি।
সন্ধ্যা অবাক হইয়া কহিল, কার বৌভাত বাবা? গোলোক ঠাকুদ্দার?
প্রিয় কহিলেন, হাঁ, প্রাণকৃষ্ণের মেয়েটাকে পরশু বিয়ে করলেন কিনা!
সন্ধ্যার মুখ দিয়া কেবল বাহির হইল, হরিমতী? তার বৌভাত?
প্রিয় কহিলেন, হাঁ হাঁ, হরিমতীই নাম বটে। গরীব বামুন বেঁচে গেল—মেয়েটা বড় হয়ে—কি রে?
কিছু না বাবা, চল আমরা এখান থেকে একটু তাড়াতাড়ি যাই। এই বলিয়া সন্ধ্যা পিতার হাত ধরিয়া তাঁহাকে একপ্রকার টানিয়া লইয়া রেল-স্টেশনের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।
পিতাকে লইয়া সে যখন স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল তখন গাড়ির প্রায় অর্ধঘণ্টা বিলম্ব আছে। পল্লীগ্রামের ছোট স্টেশন, বিশেষতঃ রাত্রি বলিয়া লোক কেহ ছিল না, শুধু প্ল্যাটফর্মের একধারে একটা করবীবৃক্ষের অন্ধকার ছায়ায় কে একটি স্ত্রীলোক বসিয়া ছিল, সে ইহাদের দেখিবামাত্রই ব্যস্ত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিল।
প্রিয় সরিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু সন্ধ্যার তীক্ষ্ণচক্ষুকে সে একেবারে ফাঁকি দিতে পারিল না। সন্ধ্যা মিনিট-খানেক নিঃশব্দে লক্ষ্য করিয়া সবিস্ময়ে বলিল, জ্ঞানদিদি, তুমি যে এখানে? একলা যে?