চাকর তামাক দিয়া গেল, শিবরতন খাতা বন্ধ করিয়া তাহা হাতবাক্সে বন্ধ করিয়া অত্যন্ত ধীরেসুস্থে ধূমপান করিতে করিতে বলিলেন, তোমার ছুটি আর ক'দিন রইল বিভূতি?
আজ্ঞে ছ'দিন।
শিবরতন মনে মনে হিসাব করিয়া বলিলেন, তা হলে শুক্রবারেই তোমাকে রওনা হতে হবে দেখছি।
বিভূতি মৃদুকণ্ঠে বলিল, আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু এই সময়টায় বড় বেশী কাজকর্ম, তাই—
শিবরতন কহিলেন, তা বেশ। না হয়, দু'দিন পূর্বেই যাও। দেবীপক্ষ—দিনক্ষণ দেখার আর আবশ্যক নেই,—সবই সুদিন। তা হলে পরশু বুধবারেই রওনা হয়ে পড়, কি বল?
বিভূতি কহিল, যে আজ্ঞে, তাই যাবো।
শিবরতন আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করিয়া একটু হাসিয়া কহিলেন, ন-বৌমার কাছে বড় অপ্রতিভ হয়ে আছি। গত বৎসর তাঁকে একপ্রকার কথাই দিয়েছিলাম যে, এ বৎসর তাঁর ছুটি,—এ বৎসর বাপের বাড়িতে তিনি পূজো দেখবেন। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল ততই ভয় হতে লাগল, তিনি না থাকলে ক্রিয়াকর্ম যেন সমস্ত বিশৃঙ্খল, সমস্ত পণ্ড হয়ে যাবে। আদর-অভ্যর্থনা করতে, সকল দিকে দৃষ্টি রাখতে তাঁর ত আর জোড়া নেই কিনা! এত কাজ, এত গণ্ডগোল, এত হাঙ্গামা, কিন্তু কখনো মাকে বলতে শুনলাম না—এটা দেখিনি, কিংবা এটা ভুলে গেছি। অন্য সময়ে সংসার চলে,—বড়বৌ ও সেজবৌমাই দেখতে পারেন, কিন্তু বৃহৎ কাজকর্মের মধ্যে আমার ন-বৌমা নেই মনে করলেই ভয়ে যেন আমার হাত-পা গুটিয়ে আসে,—কিছুতে সাহস পাইনে। এই বলিয়া স্নেহে, শ্রদ্ধায় মুখখানি দীপ্ত করিয়া তিনি পুনরায় নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলেন।
বড়কর্তার ন-বৌমার প্রতি বিশেষ একটু পক্ষপাতিত্ব আছে, ইহা লইয়া বাটীর মধ্যে আলোচনা ত হইতই, এমন কি একটা ঈর্ষার ভাবও ছিল। বড়বধূ রাগ করিয়া মাঝে মাঝে ত স্পষ্ট করিয়াই স্বামীকে শুনাইয়া দিতেন; এবং সেজবধূ আড়ালে অসাক্ষাতে এরূপ কথাও প্রচার করিতে বিরত হইতেন না যে, ন-বৌ শুধু বড়লোকের মেয়ে বলিয়াই এই খোশামোদ করা। নইলে আমরা দু-জায়ে এগারো মাসই যদি গৃহস্থালীর ভার টানতে পারি ত পূজোর মাসটা আর পারি না! বড়মানুষের মেয়ে না এলেই কি মায়ের পূজো আটকে যাবে?