এই-সকল প্রচ্ছন্ন শব্দভেদী বাণ যথাকালে যথাস্থানে আসিয়াই পৌঁছিত, কিন্তু শিবরতন না হইতেন বিচলিত, না করিতেন প্রতিবাদ। হয়ত বা কেবল একটুখানি মুচকিয়া হাসিতেন মাত্র। বিভূতি অধিক উপার্জন করে, তাহাকে বারোমাস বাসা করিয়া কলিকাতাতেই থাকিতে হয়, সুতরাং ন-বধূমাতার তথায় না থাকিলে নয়। এ কথা তিনি বেশ বুঝিতেন, কিন্তু অবুঝের দল কোনমতেই স্বীকার করিতে চাহিত না। তাহাদের একজনকে সংসারে মামুলি এবং মোটা কাজগুলা সারা বৎসর ধরিয়াই করিতে হয় না। কেবল মহামায়ার পূজা উপলক্ষে হঠাৎ একসময়ে আসিয়া সমস্ত দায়িত্ব, সকল কর্তৃত্ব, নিজের হাতে লইয়া তাহা নির্বিঘ্নে শেষ করিয়া দিয়া, ঘরের এবং পরের সমস্ত সুখ্যাতি আহরণ করিয়া লইয়া চলিয়া যায়,—সে না থাকিলে এ-সব যেন কিছু হইতে পারিত না, সমস্তই যেন এলোমেলো হইয়া উঠিত, লোকের মুখের ও চোখের এই-সকল ইঙ্গিতে মেয়েদের চিত্ত একেবারে দগ্ধ হইয়া যাইত। কাজকর্ম অন্তে এই লইয়া প্রতি বৎসরেই কিছু-না-কিছু কলহ-বিবাদ হইতই। বিশেষ করিয়া মা আজও জীবিত আছেন এবং আজও তিনিই গৃহিণী। কিন্তু বয়স অত্যন্ত বেশী হইয়া পড়ায় অপরের দোষ-ত্রুটি দেখাইয়া তিরস্কার ও গালি-গালাজ করার কাজটুকু মাত্র হাতে রাখিয়া গৃহিণীপনার বাকি সমস্ত দায়িত্বই তিনি স্বেচ্ছায় বড় ও সেজ-বধূমাতার হাতে অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছেন। তিনি ন-বৌকে একেবারে দেখিতে পারিতেন না। সে সুন্দরী, সে বড়লোকের মেয়ে, তাহার কাপড়-গহনা প্রয়োজনের অতিরিক্ত, তাহাকে সংসার করিতে হয় না, সে চিঠি লিখিতে পারে, অহঙ্কারে তাহার মাটিতে পা পড়ে না, ইত্যাদি নালিশ এগারো মাস-কাল নিয়ত শুনিতে শুনিতে এই বধূটির বিরুদ্ধে মন তাঁহার তিক্ততায় পরিপূর্ণ হইয়া থাকিত; এবং এই দীর্ঘকাল পরে সে যখন গৃহে প্রবেশ করিত, তখন তাহা অনধিকার-প্রবেশের মতই তাঁহার ঠেকিত।
কাল হইতে একটা কথা উঠিয়াছে যে, ধরণী সাণ্ডেলদের বাড়ির মেয়েদের সরায় সন্দেশ দুটো করিয়া কম পড়িয়াছিল এবং কম পড়িয়াছিল কেবল তাহারা গরীব বলিয়াই। এই দুর্নাম শুধু গ্রামে নয়, তাহা শহর ছাড়াইয়া নাকি বিলাত পর্যন্ত পৌঁছিবার উপক্রম করিয়াছে,—এই দুঃসংবাদ গৃহিণীর কানে গেল যখন তিনি আহ্নিকে বসিতেছিলেন।