এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

প্রবন্ধ  :  নারীর মূল্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 47
পুরুষ যে কেবলমাত্র নিজের সুখ ও সুবিধা ব্যতীত—সেটা সত্যই হউক আর কাল্পনিকই হউক—আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত করে নাই, সে কথা চাপা দিয়া গর্ব করিয়া প্রচার করিয়াছে, “যেদেশে নারী হাসিতে হাসিতে চিতায় গিয়া বসিত, স্বামীর পাদপদ্ম ক্রোড়ে লইয়া প্রফুল্ল মুখে নিজেকে ভস্মসাৎ করিত! ইত্যাদি ইত্যাদি—’’

কিন্তু তাই যদি হয়, তবে স্বামীর মৃত্যুর পরই তাহার বিধবাকে একবাটি সিদ্ধি ও ধুতুরা পান করাইয়া মাতাল করিয়া দেওয়া হইত কেন? শ্মশানের পথে কখন-বা সে হাসিত, কখন কাঁদিত, কখন-বা পথের মধ্যেই ঢুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে চাহিত। এই তার হাসি, এই তার সহমৃতা হইতে যাওয়া! তার পর চিতায় বসাইয়া কাঁচা বাঁশের মাচা বুনিয়া চাপিয়া ধরা হইত, পাছে সতী দাহ-যন্ত্রণা আর সহ্য করিতে না পারে! এত ধূনা ও ঘি ছড়াইয়া অন্ধকার ধুঁয়া করা হইত যে, কেহ তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া যেন ভয় না পায়! এবং এত রাজ্যের ঢাক ঢোল কাঁসি ও শাঁখ সজোরে বাজানো হইত যে, কেহ যেন তাহার চীৎকার, কান্না বা অনুনয়-বিনয় না শোনে! এই ত সহমরণ! আমি জানি, এখানে অনেক রকমের আপত্তি উঠবে। প্রথমেই উঠিবে, দেশের লোকের সত্যই যদি এই বিশ্বাস থাকে যে সহমৃতা সতী পরলোকে স্বামীর সহিত বাস করিতে পায় এবং সেইজন্যই এ অনুষ্ঠান,—তাহা হইলেও আমার এই উত্তর যে, দেশের অশিক্ষিত ইতর লোক কি বিশ্বাস করিত, না করিত, সে আলোচনায় লাভ নাই, কারণ তাহারা শুধু ভদ্র ও শিক্ষিতের অনুকরণ ও অনুগমন করিত মাত্র। কিন্তু যেদেশে তখনও টোল মহামহোপাধ্যায়েরা সাংখ্য, বেদান্ত পড়াইতেন, জন্মান্তর বিশ্বাস করিতেন, কর্মফলে স্থাবর-জঙ্গম পশুজন্ম প্রচার করিতেন, দেবযান পিতৃযান প্রভৃতি পথের নির্দেশ করিতেন, তাঁহারা যে সত্যই বিশ্বাস করিতেন, পৃথিবীতে কর্মফল যাহার যাহা হউক, দুইটা প্রাণীকে একসঙ্গে বাঁধিয়া পোড়াইলেই পরলোকে একসঙ্গে বাস করে—এ কথা স্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন।

লেকি সাহেব লিখিয়াছেন, এই প্রথা ইংরাজেরা যখন তুলিয়া দেন, তখন টোলের পণ্ডিতসমাজ চেঁচামেচি করিয়া, সভা-সমিতি করিয়া, রাজা-রাজড়ার নিকট চাঁদা তুলিয়া বিলাত পর্যন্ত আপীল করিয়াছিল। তাহাতে বলা হইয়াছিল, এ প্রথা নিষিদ্ধ হইয়া গেলে হিন্দুধর্ম বনিয়াদ-সমেত বসিয়া হিন্দু একেবারে ধর্মচ্যুত হইয়া যাইবে। নারী-পূজা বটে!

তার পর আপীল যখন নিতান্তই না-মঞ্জুর হইয়া গেল, এবং বেশ বুঝা গেল, অতঃপর ঢাক ঢোল কাঁসি শাঁখের শব্দে পিয়াদার কান ঢাকা পড়িবে না, এবং ধূনা পোড়াইয়া সমস্ত নদীর কিনারাটা অন্ধকার করিয়া ফেলিলেও দারোগার দৃষ্টি এড়াইবে না, তখন ধর্মধ্বজেরও বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, সনাতন হিন্দু-ধর্মের বনিয়াদ ইঞ্চি-কয়েক বসিয়া গেলেও যদি বা চলে, পুলিশের হাঙ্গামায় পড়িলে চলিবে না। সুতরাং অন্য পথের সন্ধান দেখিতে হইল। রাজার কাজ রাজা করিয়া গেলেন, কিন্তু সমাজ-রক্ষকের কাজ বাড়িয়া গেল। এ দুর্দিনে বসিয়া পড়িলে চলিবে না।