মা হাসিলেন,বলিলেন, মিথ্যা উপোস করে মরা কি কারও শখ রে? কিন্তু উপায় কি? এ করলে পুণ্যি নেই, না করলে অনন্ত নরক। হাঁ রে, বৌমা বলছিলেন, খবরের কাগজে লিখেছে কে একজন মস্ত পণ্ডিত কলকাতায় নাকি চমৎকার ভাগবত ব্যাখ্যা করচেন। একবার খোঁজ নে দিকি, কি হলে এ বাড়িতে তিনি পায়ের ধূলো দিতে পারেন?
তোমার হুকুম হলেই নিতে পারি মা।
কেন, আমার হুকুমেরই বা দরকার কি! তোদের শুনতে কি ইচ্ছে যায় না? সেই যে কবে কথকতা হয়ে গেল—
বিপ্রদাস সহাস্যে বাধা দিয়া কহিল, সে ত এখনো তিন মাসও হয়নি মা!
মা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, মোটে তিন মাস? কিন্তু তিন মাসই কি কম সময়? তা সে যাই হোক বাবা, এবার কিন্তু না বললে চলবে না। আমার দু মামীই চিঠি লিখেচেন। কৈলাসনাথ, মানস-সরোবর দর্শনে এবার আমি যাবই যাব।
বিপ্রদাস হাতজোড় করিয়া কহিল, দোহাই মা, ও আদেশটি তুমি করো না। তোমার দুই ছেলের একজন সঙ্গে না গেলে মামীদের জিম্মায় তোমাকে তিব্বতে পাঠাতে পারব না। আর সব ক্ষতিই সইবে, কিন্তু মাকে হারানো আমার সইবে না।
মায়ের দুই চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল, বলিলেন, ভয় নেই রে, কৈলাসের পথে মরণ হবে তেমন পুণ্যি তোর মায়ের নেই। আমি আবার ফিরে আসব। কিন্তু ছেলের মধ্যে তুই ত আমার সঙ্গে যেতে পারবি নে বিপিন, তোর পরেই এত বড় সংসারের সব ভার, আর পিছনে যে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তাকে নিয়ে আমি বৈকুণ্ঠে যেতেও রাজী নই। বামুনের ছেলে হয়ে সন্ধ্যে-আহ্নিক ত অনেকদিনই ছেড়েচে, শুনতে পাই কলকাতায় খাদ্যাখাদ্যেরও নাকি বিচার করে না। এর ওপর কাল কি করেছে শুনেছিস?
বিপ্রদাস ভালমানুষের মত মুখ করিয়া কহিল, কি আবার করলে? কৈ শুনিনি ত কিছু।
মা বলিলেন, নিশ্চয় শুনেছিস। তোর চক্ষুকে ফাঁকি দেবে এত বুদ্ধি ও-ছোঁড়ার ঘটে নেই। কিন্তু এর একটা প্রতিকার কর। ও আমারই খাবে পরবে, আর আমারই টাকায় কলকাতা থেকে লোক এনে আমার প্রজা বিগড়োবার ফন্দি আঁটবে? ওর কলকাতার খরচা তুই বন্ধ কর।
বিপ্রদাস আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে কি কথা মা, পড়ার খরচ বন্ধ করে দেব? ও পড়বে না?
মা বলিলেন, দরকার কি? আমার শ্বশুরের ইস্কুলের ছাত্ররা যখন দল বেঁধে এসে বললে, বিদেশী লেখাপড়ায় দেশের সর্বনাশ হল, তখন তাদের তুই তেড়ে মারতে গেলি। আর তোর নিজের ছোটভাই যখন ঠিক ঐ কথাই বলে বেড়ায় তার কি কোন প্রতিবিধান করবি নে? এ তোর কেমন বিবেচনা?
বিপ্রদাস হাসিমুখে কহিল, তার কারণ আছে মা। ইস্কুলের ক্লাসে প্রমোশন না পেয়ে ও নালিশ করলে আমার সয় না, কিন্তু দ্বিজুর মত এম.এ. পাস করে বিলিতী শিক্ষাকে যত খুশি গাল দিয়ে বেড়াক আমার গায়ে লাগে না।