এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  দেনা-পাওনা         
পরিচ্ছেদ: / 28
পৃষ্ঠা: / 183
এককড়ি ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনিব কহিলেন, তোমার নাম এককড়ি নন্দী? তুমিই এখানকার গোমস্তা?

ভয়ে এককড়ির হৃৎপিণ্ড দুলিতেছিল, সে অস্ফুট কম্পিতকন্ঠে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুজুর!

সে ভাবিয়া আসিয়াছিল এইবার এই বাড়ির কথা উঠিবে, কিন্তু হুজুর তাহার কোন উল্লেখ করিলেন না, শুধু জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কাছারির তসিল কত?

এককড়ি বলিল, আজ্ঞে, প্রায় হাজার-পাঁচেক টাকা।

হাজার-পাঁচেক? বেশ আমি দিন-আষ্টেক আছি, তার মধ্যে হাজার-দশেক টাকা চাই।

এককড়ি কহিল, যে আজ্ঞে।

তাহার মনিব বলিলেন, কাল সকালে তোমার কাছারিতে গিয়ে বসব—বেলা দশটা-এগারোটা হবে—তার পূর্বে আমার ঘুম ভাঙ্গে না। প্রজাদের খবর দিও।

এককড়ি সানন্দে মাথা নাড়িয়া কহিল, যে আজ্ঞে। কারণ ইহা বলা বাহুল্য যে খাজনার অতিরিক্ত টাকা আদায়ের গুরুভারে এককড়ি আপনাকে নিরতিশয় প্রপ্রীড়িত বা বিপন্ন জ্ঞান করে নাই। সে পুলকিত-চিত্তে কহিল, আমি রাত্রের মধ্যেই আজ চতুর্দিকে লোক পাঠিয়ে দেব যেন কেউ না বলতে পারে সে সময়ে খবর পায়নি।

জীবানন্দ মাথা হেলাইয়া সম্মতি দান করিলেন, এবং মদের পাত্রটা মুখে তুলিয়া সমস্তটা এক চুমুকে পান করিয়া সেটা ধীরে ধীরে রাখিয়া দিতে দিতে বলিলেন, এককড়ি, তোমাদের এখানে বোধ করি বিলিতী মদের দোকান নেই! তা না থাক, যা আমার সঙ্গে আছে তাতেই এ ক'টা দিন চলে যাবে, কিন্তু মাংস আমার রোজ চাই।

এককড়ি প্রস্তুত হইয়াই ছিল, কহিল, এ আর বেশী কথা কি হুজুর, মা চন্ডীর সরেস মহাপ্রসাদ আমি রোজ হুজুরে দিয়ে যাবো।

হুজুর খুশী হইয়া কহিলেন, বেশ, বেশ। তার পরে বোতল হইতে কতকটা সুরা পাত্রে ঢালিয়া তাহা পান করিলেন, এবং মুখ মুছিতে মুছিতে বলিলেন, আরও একটা কথা আছে এককড়ি।

এককড়ির সাহস বাড়িতেছিল, কহিল, আজ্ঞে করুন?

তিনি মুখের মধ্যে গোটা-দুই লবঙ্গ ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, দেখ এককড়ি, আমি বিবাহ করিনি—বোধ হয় কখনো করবও না।

এককড়ি মৌন হইয়া রহিল। তখন এই মদ্যপ ভূস্বামী একটা শুষ্কহাস্য করিয়া কহিলেন, কিন্তু তাই বলে আমি ভীষ্মদেব—বলি মহাভারত পড়েচ ত? আর ভীষ্মদেব সেজেও বসিনি—শুকদেব হয়েও উঠিনি—বলি, কথাটা বুঝলে ত এককড়ি? ওটা চাই।

এককড়ি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল, মুখ ফুটিয়া জবাব দিতে পারিল না; কিন্তু যে নির্লজ্জ উক্তিতে জমিদারের গোমস্তার পর্যন্ত লজ্জা বোধ হয়, এ কথা যিনি অবলীলাক্রমে উচ্চারণ করিলেন, তিনি ইহা গ্রাহ্যও করিলেন না।