তাই ক'রো।
সেইদিন চন্দ্রনাথ হরিদয়াল ঠাকুরকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বাটীতে সরকার মহাশয়কে এইরূপ পত্র লিখিল—
আমি কাশীতে আছি। এখানে এই মাসের মধ্যেই বিবাহ করিব স্থির করিয়াছি। মাতুল মহাশয়কে এ কথা বলিবেন এবং আপনি কিছু অর্থ, অলঙ্কার এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লইয়া শীঘ্র আসিবেন।
সেই মাসেই চন্দ্রনাথ সরযূকে বিবাহ করিল।
তাহার পর বাড়ি যাইবার সময় আসিল। সরযূ কাঁদিয়া বলিল, মার কি হবে?
আমাদের সঙ্গে যাবেন।
কথাটা বামুন-ঠাকরুণের কানে গেল। তিনি কন্যা সরযূকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, সরযূ, সেখানে গিয়ে তুই আমার কথা মাঝে মাঝে মনে করিস, কিন্তু আমার নাম কখনো মুখে আনিস না। যত দিন বাঁচবো কাশী ছেড়ে কোথাও যাব না। তবে যদি কখনো তোমাদের এ অঞ্চলে আসা হয়, তা হ'লে আবার দেখা হতে পারে।
সরযূ কাঁদিতে লাগিল।
জননী তাহার মুখে অঞ্চল দিয়া কান্না নিবারণ করিলেন, এবং গম্ভীর হইয়া কহিলেন, বাছা, সব জেনেশুনে কি কাঁদতে আছে?
কন্যা জননীর কোলের ভিতর মুখ লুকাইয়া ডাকিল, মা—
তা হোক। মায়ের জন্য যদি মাকে ভুলতে হয়, সেই ত মাতৃভক্তি মা!
চন্দ্রনাথ অনুরোধ করিলেও তিনি ইহাই বলিলেন। কাশী ছাড়িয়া তিনি আর কোথাও যাইতে পারিবেন না।
চন্দ্রনাথ বলিল, একান্ত যদি অন্যত্র না যাবেন, তবে অন্ততঃ স্বাধীনভাবে কাশীতে বাস করুন।
বামুন-ঠাকরুন তাহাও অস্বীকার করিয়া বলিলেন, হরিদয়াল ঠাকুর আমাকে মেয়ের মত যত্ন করেন এবং নিতান্ত দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আমিও তাঁকে পিতার মত ভক্তি করি; তাঁকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না।
চন্দ্রনাথ বুঝিল, দুঃখিনীর আত্মসম্ভ্রম বোধ আছে, সাধ করিয়া তিনি কাহারও দয়ার পাত্রী হইবেন না। কাজেই তখন শুধু সরযূকে লইয়া চন্দ্রনাথ বাটী ফিরিয়া আসিল।
এখানে আসিয়া সরযূ দেখিল, প্রকাণ্ড বাড়ি! কত গৃহসজ্জা, কত আসবাব—তাহার আর বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে মনে মনে ভাবিল, কি অনুগ্রহ! কত দয়া!
চন্দ্রনাথ বালিকা বধূকে আদর করিয়া কহিল, বাড়িঘর সব দেখলে? মনে ধরেচে ত?
সরযূ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া আঁচলে মুখ লুকাইয়া মাথা নাড়িল।
চন্দ্রনাথ স্ত্রীর মনের কথা বুঝিতে চাহে নাই; প্রত্যুত্তরে কণ্ঠস্বর শুনিতে চাহিয়াছিল, তাই দুই হাতে সরযূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া কহিল, কি বল, মনে ধরেছে ত?
লজ্জায় সরযূর মুখ আরক্ত হইয়া গেল, কিন্তু স্বামীর পুনঃ পুনঃ প্রশ্নে কোনরূপে সে বলিয়া ফেলিল, সব তোমার?
চন্দ্রনাথ হাসিয়া কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিল, হাঁ, সব তোমার।