সত্যাশ্রয়ী
ছাত্র, যুবক ও সমবেত বন্ধুগণ,—বাংলাভাষায় শব্দের অভাব ছিল না; অথচ, এই আশ্রমের যাঁরা প্রতিষ্ঠাতা, তাঁরা বেছে বেছে এর নাম দিয়েছিলেন 'অভয় আশ্রম'। বাইরের লোকসমাজে প্রতিষ্ঠানটিকে অভিহিত করার নানা নামই ত ছিল, তবু তাঁরা বললেন—অভয় আশ্রম। বাইরের পরিচয়টা গৌণ, মনে হয় যেন সঙ্ঘ স্থাপনা করে বিশেষভাবে তাঁরা নিজেদেরই বলতে চেয়েছিলেন—স্বদেশের কাজে যেন আমরা নির্ভয় হতে পারি, এ জীবনের যাত্রাপথে যেন আমাদের ভয় না থাকে। সর্বপ্রকার দুঃখ, দৈন্য ও হীনতার মূলে মনুষ্যত্বের চরম শত্রু ভয়কে উপলব্ধি করে বিধাতার কাছে তাঁরা অভয় বর প্রার্থনা করে নিয়েছিলেন। নামকরণের ইতিহাসে এই তথ্যটির মূল্য আছে; এবং আজ আমার মনের মধ্যে কোন সংশয় নেই যে, সে আবেদন তাঁদের বিধাতার দরবারে মঞ্জুর হয়েছে। কর্মসূত্রে এঁদের সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয়। দূরে থেকে সামান্য যা-কিছু বিবরণ শুনতে পেতাম, তার থেকে মনের মধ্যে আমার এই আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল—একবার নিজের চোখে গিয়ে সমস্ত দেখে আসব। তাই, আমার পরম প্রীতিভাজন প্রফুল্লচন্দ্র যখন আমাকে সরস্বতীপূজা উপলক্ষে এখানে আহ্বান করলেন, তাঁর সে আমন্ত্রণ আমি নিরতিশয় আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলাম। শুধু একটি মাত্র শর্ত করিয়ে নিলাম যে, অভয় আশ্রমের পক্ষ থেকে আমাকে অভয় দেওয়া হোক যে, মঞ্চে তুলে দিয়ে আমাকে অসাধ্য-সাধনে নিযুক্ত করা হবে না। বক্তৃতা দেবার বিভীষিকা থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হবে। জীবনে যদি কিছুকে ভয় করি ত একেই করি। তবে এটুকুও বলেছিলাম—যদি সময় পাই ত দু-এক ছত্র লিখে নিয়ে যাব। সে লেখা প্রয়োজনের দিক থেকেও যৎসামান্য, উপদেশের দিক দিয়েও অকিঞ্চিৎকর। ইচ্ছে ছিল, কথার বোঝা আর না বাড়িয়ে উৎসবের মেলামেশায় আপনাদের কাছ থেকে আনন্দের সঞ্চয় নিয়ে ঘরে ফিরব। আমি সে সঙ্কল্প ভুলিনি এবং এই দু-দিনে সঞ্চয়ের দিক থেকেও ঠকিনি। কিন্তু এ আমার নিজের দিক। বাইরেও একটা দিক আছে, সে যখন এসে পড়ে, তার দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় না। তেমনি এলো প্রফুল্লচন্দ্রের ছাপানো কার্য-তালিকা। রওনা হতে হবে, সময় নেই,—কিন্তু পড়ে দেখলাম, অভয় আশ্রম পশ্চিম-বিক্রমপুর-নিবাসী ছাত্র ও যুবকদের মিলনক্ষেত্রের আয়োজন করেছে। ছেলেরা এখানে সমবেত হবেন। তাঁরা আমাকে অব্যাহতি দেবেন না; বলবেন,—কিশোর বয়স থেকে ছাপা-বইয়ের ভিতর দিয়ে আপনার অনেক কথা শুনেছি, আজও যখন কাছে পেয়েছি, তখন যা হোক কিছু না শুনে ছাড়ব না। তারই ফলে এই কয়েক ছত্র আমার লেখা। মনে হবে তা বেশ ত, কিন্তু এতবড় ভূমিকার কি আবশ্যক ছিল? তার উত্তরে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভিতরের বস্তু যখন কম থাকে, তখন মুখবন্ধের আড়ম্বর দিয়েই শ্রোতার মুখ বন্ধের প্রয়োজন হয়।