কত কথা, কত ভাবা! যেমন গভীরতা, তেমনি বিস্তৃতি, তেমনি পাণ্ডিত্য। বেদ, বেদান্ত, ন্যায়, গীতা, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, কালিদাসের ছড়া, উজ্জ্বল-নীলমণি, মায় ব্যাকরণের অধিকরণ কারক পর্যন্ত। বাপ্ রে বাপ! মানুষে এত পড়েই বা কখন এবং মনে রাখেই বা কি করিয়া!
ইহার পার্শ্বে 'লাল শালু-মণ্ডিত বংশখণ্ড-নির্মিত ক্রীড়া-গাণ্ডীব'-ধারী নরেশচন্দ্র একেবারে চ্যাপটাইয়া গিয়াছেন। আজ ছেলেবেলার একটা ঘটনা মনে পড়িতেছে। আমাদের অবৈতনিক নব-নাট্যসমাজের বড় অ্যাক্টর ছিলেন নরসিংহবাবু। রাম বল, রাবণ বল, হরিশ্চন্দ্র বল, তাঁহারই ছিল একচেটে। হঠাৎ আর একজন আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাঁর নাম রাম-নরসিংবাবু। আরও বড় অ্যাক্টর! যেমন দরাজ গলার হুঙ্কার, তেমনি হস্ত-পদ সঞ্চালনের অপ্রতিহত পরাক্রম। যেন মত্তহস্তী। এই নবাগত রাম-নরসিংবাবুর দাপটে আমাদের শুধু নরসিংবাবু একেবারে তৃতীয়ার শশিকলার ন্যায় পাণ্ডুর হইয়া গেলেন। নরেশবাবুকে দেখি নাই, কিন্তু কল্পনায় তাঁহার মুখের চেহারা দেখিয়া বোধ হইতেছে, যেন তিনি যুক্ত-হস্তে চতুরাননকে গিয়া বলিতেছেন, প্রভু! ইহার চেয়ে যে আমার বনে বাস করা ভাল!
দ্বিজেন্দ্রবাবুর তর্ক করিবার রীতিও যেমন জোরালো, দৃষ্টিও তেমনি ক্ষুরধার। রায়ের মুসাবিদায় কোথাও একটি অক্ষরও যেন ফাঁক না পড়ে এমনি সতর্কতা। যেন বেড়াজালে ঘেরিয়া রুই-কাতলা হইতে শামুক-গুগলি পর্যন্ত ছাঁকিয়া তুলিতে বদ্ধপরিকর।
হায় রে বিচার! হায় রে সাহিত্যের রস! মথিয়া মথিয়া আর তৃপ্তি নাই। ডাইনে ও বামে রবীন্দ্রনাথ ও নরেশচন্দ্রকে লইয়া অক্লান্তকর্মী দ্বিজেন্দ্রনাথ নিরপেক্ষ সমান-তালে যেন তুলাধুনা করিয়াছেন।
কিন্তু ততঃ কিম্?
এই কিম্টুকুই কিন্তু ঢের বেশী চিন্তার কথা। নরেশচন্দ্র অথবা দ্বিজেন্দ্রনাথ ইঁহারা সাহিত্যিক মানুষ। ইঁহাদের ভাব-বিনিময় ও প্রীতি-সম্ভাষণ বুঝা যায়। কিন্তু এই সকল আদর-আপ্যায়নের সূত্র ধরিয়া যখন বাহিরের লোকে আসিয়া উৎসবে যোগ দেয়, তখন তাহাদের তাণ্ডব-নৃত্য থামাইবে কে?