কানকাটা
গত ফাল্গুনের (১৩১৯) 'সাহিত্যে' শ্রীযুক্ত ঋতেন্দ্রবাবুর “কানকাটা” ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণীত হইয়াছে। তথ্যটি সত্য কিংবা অসত্য আলোচিত হইবার পূর্বে একটা সন্দেহ স্বতঃই মনে উঠে, ঠাকুরমশাই প্রবন্ধটি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখেন নাই ত? কেননা, ইহা সত্য সত্যই সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা এবং যথার্থই সত্য, তাহা মনে করিলেও দুঃখ হয়। তবে যদি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখিয়া থাকেন, তাহা হইলে প্রবন্ধটি নিশ্চয়ই সার্থক হইয়াছে। কিন্তু আর কোন উদ্দেশ্য থাকিলে বোধ করি ব্যর্থ হইয়াছে এবং হওয়াই মঙ্গল। যাহা হউক, উক্ত প্রবন্ধে ঠাকুরমশাই বলিয়াছেন, “কানকাটা, কন্দকাটা, বা উড়িষ্যার খোন্দ জাতিরা বাইবেল-কথিত কানানাইট জাতি ভিন্ন আর কিছুই নয়।” এই 'কিছুই নয়'টি প্রমাণ করিবার জন্য তিনি এই উভয় জাতির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়াছেন এবং জাতিতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন। আমার এক আত্মীয় সেদিন বলিতেছিলেন, আজকাল বাঙ্গালাদেশে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের লেখক সবাই। কেবল ঝগড়া করিতে চায়—রামের আঁতুর-ঘর পশ্চিমমুখো কিংবা পূবমুখো ছিল। কথাটা তাঁহার নিতান্ত মিথ্যা নয় দেখিতেছি।
কিন্তু, জাতিতত্ত্ব জিনিসটি শুধু যদি খেলনার জিনিস হইত, কিংবা শখ করিয়া খান-দুই এ-ও-তা বই নাড়াচাড়া করিলেই ইহাতে ব্যুৎপত্তি জন্মিত, তাহা হইলে, আমার এ প্রতিবাদের আবশ্যকতা ছিল না। কিন্তু তাহা নহে। ইহা সত্য-উদ্ঘাটন—চুট্কি গল্প লেখা নহে। অতএব, জাতিতত্ত্ববিৎ বলিয়া প্রবন্ধ লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করিবার পূর্বে কিছু 'সলিড' পরিশ্রমের আবশ্যক। সুতরাং যে দুর্ভাগারা অনেকদিন ধরিয়া গায়ের অনেক রক্ত জল করিয়া নীরস বইগুলি ঘাঁটিয়া মরিয়াছে, এ ভার তাহাদের উপর দিয়া নিশ্চিন্ত মনে সরস কবিতা এবং রসাল সাহিত্যিক প্রবন্ধে বা গল্পে মনোনিবেশ করাই বুদ্ধির কাজ। খান-দুই বই ভাসা ভাসা রকম দেখিয়া লইয়া এবং গোটা-দুই সাদৃশ্য উপরে উপরে মিলাইয়া দিয়া একটা অভিনব সত্য প্রচার করিতে পারা সাহসের পরিচয় সন্দেহ নাই; কিন্তু এ সাহসে কাজ হয় না, শুধু অকাজ বাড়ে। যেমন, তাঁহার দেখাদেখি আমার অকাজ বাড়িয়া গিয়াছে এবং যে হতভাগ্যেরা এগুলো পড়িবে, তাহাদের ত কথাই নাই। অবশ্য, পুরুষমানুষের সাহস থাকা ভাল, কিন্তু একটু কম থাকাও আবার ভাল। যা হউক কথাটা এই। ঠাকুরমশাই উড়িষ্যার (কলিঙ্গ) খোন্দ এবং বাইবেলের কানানাইটের মধ্যে গুটি পাঁচ-ছয় মিল দেখিয়াই উভয়কে সহোদর ভাই বলিয়া স্থির করিয়াছেন, কিন্তু গরমিলের ধার দিয়াও যান নাই। অবশ্য গরমিল দেখিতে যাইবার অসুবিধা আছে বটে, এবং এই অসুবিধা ভোগ না করিয়াও যা হউক একটা কিছু লেখা যায় সত্য, কিন্তু তাহাকে সত্য আবিষ্কার বলে না। যাহা বলে তাহা পিক্উইক পেপারের আরম্ভটা। তা ছাড়া, শুধু সাদৃশ্য দেখিয়াই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে কত বিপজ্জনক, তাহার একটা সামান্য দৃষ্টান্ত দিতেছি। এই সেদিন চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা থালায় জল লইয়া হাঁ করিয়া বসিয়াছিল।