বারোয়ারি উপন্যাস
একুশ
অরুণের মুখে শাশুড়ীর ওই দুর্দান্ত অসুখের কথা শুনে কমলার দু'চক্ষু ছলছল করে এল। এবং বিশেষ করে সে যখন জানালে যে, জামাইবাবু নিরুদ্দেশ, হয়ত বা তিনি এখন হিমালয়ের কোন গুহার মধ্যে তপস্যায় নিযুক্ত, এবং তাঁকে একটা সংবাদ দেওয়া পর্যন্ত সম্ভবপর নয়, তখন সেই দুটি চোখ দিয়ে বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ধারা বেয়ে নেমে এল।
হঠাৎ কি কারণে যে সতীশ সংসার ত্যাগ করে চলে গেল, এ কথা মনে মনে সবাই বুঝলে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলে না।
অরুণ বললে, শুধু কি এই? ডাক্তারের কাছে শুনে এলুম, দুর্নামের ভয়ে পাড়ার কেউ শুশ্রূষা পর্যন্ত করতে রাজী নয়। একেই ত ওদের গ্রামে মানুষের চেয়ে জানোয়ারই বেশি, তার ওপর যদি এই উৎপাত হয় ত বুড়ী বেঘোরেই মারা যাবে।
কমলা আঁচলে চোখ মুছে অশ্রুরূদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, হাঁ অরুণ, মা কি তবে একলাই পড়ে আছেন? মুখে একফোঁটা জল দেবারও কি কেউ নেই?
অরুণ বললে, অবস্থা ত তাই বটে,—আমাকে ত একরকম দোর ভেঙ্গেই বাড়ি ঢুকতে হয়েছিল। তবে আজ রাতটার মত একটা বন্দোবস্ত করে এসেচি, ডাক্তারবাবু তাঁর হিন্দুস্থানী দাসীটাকে পাঠিয়ে দেবেন ভরসা দিয়েছেন ।
যাক বাঁচা গেল! বলে, হরেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, রাতটা ত কাটুক;—ভোর পাঁচটায় একটা ট্রেন আছে। আমরা তাইতে বেরিয়ে পড়লে সকাল নাগাদ কমলাকে পৌঁছে দিতে পারবো।
ক্ষিতীশ এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ কোরেই ছিল, মুখ তুলে বললে, কমলাকে নিয়ে যাবে? হঠাৎ ওঁকে নিয়ে গিয়ে কি সুবিধে হবে হরেন?
বাঃ—সুবিধে হবে না? সতীশ যখন নেই, তখন শাশুড়ীর সমস্ত দায়িত্ব ত এখন ওরই। তাছাড়া দেখবে কে? শুনলে ত গ্রামের মেয়েরা দুর্নামের ভয়ে বুড়ীর কাছে ঘেঁষতে পর্যন্ত রাজী নয়। কে সেবা করে বল ত?
ক্ষিতীশ লোকটি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিও নয়, আগাগোড়া ভেবে-চিন্তে হুঁশিয়ার হয়ে কাজ করাও তার স্বভাব নয়, কিন্তু ভিতরের একটা গোপন বেদনা কিছুদিন থেকে ওই দিকের দৃষ্টিকে তার অত্যন্ত প্রখর কোরে তুলেছিল, সে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বললে, কথাটা ঠিক সত্যি নয় হরেন। আমার মনে হয়, তাঁর অসুখের খবর পাড়ার মেয়েরা জানেন না। কারণ, আমার নিজের বাড়িও ত পল্লীগ্রামে, সেখানে বাপের বাড়ি থেকে বৌ হারিয়ে গেলে, শাশুড়ীর জাত যেতে আমি আজও দেখিনি, এবং এই দোষে পাড়ার মেয়েরা পীড়িতের সেবা করেন না, এত বড় কলঙ্কও তাঁদের দেওয়া চলে না হরেন।