অভিযোগটা হরেনের নিজের গায়েও বিঁধল। সে লজ্জিত মুখে জবাব দিলে, বেশ ত ক্ষিতীশ, সেবা না হয় তাঁরা করতে পারেন, কিন্তু তাই বলে এত বড় একটা টাইফয়েড রোগের সেবাও তাঁরা নিয়মিত কোরে যাবেন, এত বড় বোঝাও ত তাঁদের উপর চাপানো যায় না, ভাই।
ক্ষিতীশ বললে, ওটা যে টাইফয়েড তাও নিশ্চয় বলা যায় না। অন্ততঃ একটা দিনের জ্বরকে অত বড় একটা নামের ঘটা দিয়ে না ডাকাই ভাল হরেন।
হরেন চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলে, তাহলে কি করা যায় বল?
এতক্ষণ পর্যন্ত অরুণ বড়দের কথায় কথা কয়নি, চুপ কোরেই শুনছিল, এবার বলে উঠলো, দিদির শাশুড়ী সকাল থেকে জ্বরে বেহুঁশ, এই আমি শুনে এসেছি, কিন্তু জ্বরটা যে কেবল আজই হয়েছে তাও ত জানিনে। হয়ত বা ক'দিন থেকে—
ক্ষিতীশ কথাটা তার শেষ করতেও দিলে না, কানেও নিলে না, বললে, তা ছাড়া একটা বড় কথা আছে হরেন। তাঁর সামান্য জ্বর হয় ত দু-চার দিনেই সেরে যাবে, কিন্তু মাঝখানে সহসা কমলাকে নিয়ে গেলে পল্লীগ্রামে কত বড় একটা সামাজিক বিপ্লবের সৃষ্টি হতে পারে, ভেবে দেখ দিকি? সতীশের মা জ্বরের ঘোরে হয়ত বলেছেন যে তিনি কমলার কলঙ্ক বিশ্বাস করেন না, কিন্তু—
কিন্তুটা ওইখানেই থেমে গেল। অরুণের মত ক্ষিতীশের নিজের বক্তব্যটাও শেষ হতে পেল না। কমলা এতদূর পর্যন্ত নীরবে শুনছিল, হঠাৎ তার কান্না যেন একেবারে সহস্রধারে ফেটে পড়ল। অশ্রু-বিকৃত কন্ঠে সে বলে উঠলো, কিন্তু, কি ক্ষিতীশদা? আমাকে কি তোমরা এইখানেই বেঁধে রাখতে চাও? আমার শাশুড়ীর ব্যামো, তিনি কাছে নেই, আমি না গেলে কে যাবে বল ত?
ক্ষিতীশ হতবুদ্ধি হয়ে বলতে গেল, তা বটে, কিন্তু ভেবে দেখলে
কমলা তেমনি কাঁদতে কাঁদতে বললে, ভেবে কি দেখতে চাও, শুনি? কেবল ভেবে ভেবেই ত আজ আমার এই দশা করেছ। হরেনের মুখের দিকে চোখ তুলে বললে, আমি দোষ করিনি,আমার ভালর জন্যে যদি তোমরা অত ফন্দি-ফিকির না করে সোজা আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে ত আজ হয়ত আমার ভালই হতো; তোমাদেরও আমার জন্যে এমন ভেবে সারা হতে হতো না। আমি আর তোমাদের সাহায্য চাইনে, কেবল অরুণকে সঙ্গে নিয়ে কাল ভোরেই চলে যাবো । আমার ভাগ্যে যা আছে, তা হোক, তোমরা আর আমার ভালর চেষ্টা কোরো না ।
ক্ষিতীশ এবং হরেন দুজনেই চমকে গেল । কমলাকে এমন জোরে কথা বলতে কেউ কখনো শোনেনি । ভাল-মন্দ সম্বন্ধে তার নিজের ব্যক্তিগত যে কোন মতামত আছে, আপনার দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া, এবং তার সংশোধনের সমস্ত ভার অপরের উপর নির্ভর করা ভিন্ন সেও যে আবার মনে মনে কিছু চিন্তা করে, এ কথা তারা দুজনেই যেন একপ্রকার ভুলে গিয়েছিল ।