দুলে মেয়েটির ভয় ও লজ্জার অবধি ছিল না। সে ছাগশিশুটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া শুধু বলিল, মাঠান আমি ছুঁইনি।
ছুঁস্নি যদি তবে এ-পাড়ায় এসেচিস কেন?
মেয়ে হাত তুলিয়া অদূরে কোন একটা অদৃশ্য গৃহ নির্দেশ করিয়া কহিল, ঠাকুরমশাই তেনার ওই গইলের ধারে আমাদের থাকতে দিয়েচে। মাকে আর আমাকে দাদামশাই তেইড়ে দিয়েচে না!
যাহারাই হোক এবং যেজন্যই হোক, একজনের দুর্গতির ইতিহাসে রাসমণির ক্রুদ্ধ হৃদয় কথঞ্চিৎ প্রফুল্ল হইল এবং এর রুচিকর সংবাদ সবিস্তারে আহরণ করিতে তিনি কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিলেন, বটে? বলি, কবে তাড়িয়ে দিলে লো?
পরশু রাত্তিরে মাঠান।
ও তুই এককড়ে দুলের মেয়ে বুঝি? তাই বল্। এককড়ে মরতে না মরতে বুড়ো তোদের বে'র করে দিলে? ছোটজাতের মুখে আগুন! তা বাপু, দিলে বলেই কি তোরা বামুনপাড়ায় এসে থাকবি? তোদের আস্পর্দা ত কম নয় লা! কে আনলে তোর মাকে? রামতনু বাঁড়ুয্যের জামাই বুঝি? নইলে এমন বিদ্যে আর কার! ঘরজামাই ঘরজামাইয়ের মত থাক্, তা না, শ্বশুরের বিষয় পেয়েচিস বলে পাড়ার মধ্যে হাড়ি-ডোম-দুলে ক্যাওরা এনে বসাবি।
এই বলিয়া রাসমণি হাঁক দিয়া ডাকিলেন, বলি সন্ধ্যা—ও সন্ধ্যা, ঘরে আছিস গা?
সামান্য একটুখানি পোড়ো জমির ওধারে রামতনু বাঁড়ুয্যের খিড়কি। তাঁহার ডাক শুনিয়া অদূরবর্তী খিড়কির দ্বার খুলিয়া একটি উনিশ-কুড়ি বছরের সুশ্রী মেয়ে মুখ বাহির করিয়া সাড়া দিল—কে ডাকে গা? ওমা, দিদিমা যে! কেন গা! বলিতে বলিতে সে বাহির হইয়া আসিল।
রাসমণি কহিলেন, তোর বাপের আক্কেলটা কি রকম শুনি বাছা? তোর দাদামশাই রামতনু বাঁড়ুয্যে—একটা ডাকসাইটে কুলীন, তার ভিটেবাড়িতে আজ প্রজা বসল কিনা বাগদী-দুলে! কি ঘেন্নার কথা মা!
এই বলিয়া গালে একবার হাত দিয়াই পুনশ্চ কহিতে লাগিলেন, তোর মাকে একবার ডাক। জগো এর কি বিহিত করে করুক, নইলে চাটুয্যেদাদাকে গিয়ে আমি নিজে জানিয়ে আসব। সে ত একটা জমিদার! একটা নামজাদা বড়লোক। সে কি বলে একবার শুনি।
সন্ধ্যা অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েচে দিদিমা?
ডাক্ না একবার তোর মাকে। তাকে বলে যাচ্চি কি হয়েচে।
এই বলিয়া নাতিনীকে দেখাইয়া কহিলেন, এই যে মেয়েটা মঙ্গলবারের বারবেলায় ছাগলদড়ি ডিঙিয়ে ফেললে, ওই যে দুলে ছুড়ী আঁচল ঘুরিয়ে বাছাকে ছুঁয়ে দিলে—
সন্ধ্যা দুলে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করিল, তুই ছুঁয়ে ফেলেচিস?