সেদিন স্নেহলতার আত্মবিসর্জনকাহিনী সংবাদপত্রে পড়িয়াই মনে হইয়াছিল ঠিক এমনি করুণ, এমনি স্বার্থত্যাগের চিত্র কিছুদিন পূর্বে গল্প-সাহিত্যে পড়িয়াছিলাম। সে মেয়েটিও দরিদ্র পিতাকে দুঃখ-কষ্ট হইতে অব্যাহতি দিবার জন্যই আত্মবিসর্জন করিয়াছিল। তাহারও বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইতেছিল এবং পাত্র পাওয়া যাইতেছিল না।
সংবাদপত্রের কাহিনী ঐ একটি স্নেহলতাতেই সত্য, কিন্তু কবির কল্পনায় যে মেয়েটি আত্মহত্যা করিয়াছিল, তাহা হয়ত শত-সহস্রে সত্য।
স্নেহলতা শিক্ষিতা ছিলেন, কে জানে তিনি এই কাহিনী পড়িয়াছিলেন কি না, এবং স্বার্থত্যাগ-মন্ত্র ইহাতেই পাইয়াছিলেন কি না!
আমার বিশ্বাস কিন্তু এই। আমার নিশ্চয় মনে হয়, তিনি লেখাপড়া না জানিলে, সাহিত্যচর্চা না করিয়া থাকিলে কিছুতেই এ শক্তি, এ বল নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইতেন না। কবির কল্পনা এমনি করিয়াই সত্য হয়, কবির কল্পনা এমনি করিয়াই কাজ করে।
দেশের কল্পনায় দেশের সাহিত্য, দেশের ইতিহাস বড় হউক, জীবন্ত হউক, সত্য হউক, সুন্দর হউক, এই প্রার্থনাই আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করিতেছি। প্রত্যেক সুসন্তান অকপটে মাতৃভাষার সেবা করুন, এইটুকু মাত্র ভিক্ষা আপনাদের কাছে সবিনয়ে করিতেছি। কিন্তু কি করিলে সাহিত্য ঠিক অমনটি হইবে, সে পরামর্শ দিবার স্পর্ধা আমার নাই। শুধু এইটুকু মাত্র বলিতে পারি, যাহা সত্য বলিয়া মনে হইবে, অন্তরের সহিত যাহাকে সুন্দর বলিয়া বুঝিবেন, নিজের সাধ্যমত সেই পথ ধরিয়াই চলিবেন—তার পরে ফল ভবিষ্যতের হাতে।
যাঁহারা বড় সাহিত্যিক, বড় সমালোচক তাঁহারা পরামর্শ দিতেছেন, উপদেশ দিতেছেন ইংরাজি ভাব, ইংরাজি ভঙ্গী ত্যাগ করিয়া খাঁটি স্বদেশী হইতে; আমি নিজেও একজন অতি ক্ষুদ্র নগণ্য সাহিত্যসেবক, কিন্তু দুঃখের সহিত স্বীকার করিতেছি, তাঁহাদের পরামর্শ, তাঁহাদের উপদেশ যে ঠিক কি, তাহা এখন পর্যন্ত বুঝি নাই।
কে কোথায় হ্রস্ব-ই-কার স্থানে ঈ দিয়াছেন, কে কোথায় ‘অ’-কারের পরিবর্তে ‘ও’-কার ব্যবহার করিয়া ভয়ানক অন্যায় করিয়াছেন, কে কোথায় কোন্ বিধবা বঙ্গনারীকে দিয়া এক মুমূর্ষু হতভাগ্য পরপুরুষের মুখে জল দিয়া সাহিত্যে বিষম কুরুচি টানিয়া আনিয়াছেন, এই-সব লইয়া সাহিত্যক্ষেত্রে মহা তোলপাড় হইতেছে, কেন হইতেছে, যথার্থ কি তাহাতে দোষ, কি হইলে ঠিকটি হইত, এ-সব খুঁটিনাটি আয়ত্ত করিয়া তাহাতে মতামত দিবার ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি কিছুই আমার নাই।
কোন সাহিত্য-সেবককেই আমি উপদেশ দিতে পারি না, এই কর কিংবা এই করা উচিত।
শুধু এইটুকু বলি, হৃদয়ের মধ্যে এই সত্য জাগাইয়া রাখিয়া সাহিত্যসেবা করুন, যেন আপনার সেবা মাতৃভাষার দ্বার দিয়া স্বদেশবাসীকে কল্যাণের পথে লইয়া যায়। তখন কি উচিত, কি উচিত নয়, তাহা দেশের হৃদয় ও প্রাণই বলিয়া দিবে।