এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা  :  আগামীকাল         
পরিচ্ছেদ: / 3
পৃষ্ঠা: / 20
আগামীকাল

প্রথম পরিচ্ছেদ

স্বদেশ–কল্যাণ–সঙ্ঘের মাসিক অধিবেশন বসবে সন্ধ্যা সাতটায়, এখন ঘড়িতে বাজল চারটে। অনেক দেরি। এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট এককড়ি। প্রদীপে আলো জ্বালাবার লোকের অভাব হয়নি, কিন্তু তেল যোগাতে হয় একাকী তাকেই। তার গৃহেই সঙ্ঘের অফিস, তার বসবার ঘরেই বসে সঙ্ঘের বৈঠক। মেঝের আগাগোড়া সতরঞ্চি পাতা, তার উপর ফরসা চাদর এবং দেয়ালের ধারে ধারে রাখা অনেকগুলি তাকিয়া। এরই একটা অধিকার করে এককড়ি গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়ে চোখ বুজে বোধ করি বা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, এমন সময় নিঃশব্দ পদক্ষেপে প্রবেশ করল জলধি। আসন গ্রহণ করে ডাকলে, এককড়িদা কি ঘুমিয়ে পড়লেন?

এককড়ি চোখ মেলে উঠে বসলো। হাই তুলে তুড়ি দিয়ে গম্ভীর মুখে বললে, গভীর চিন্তামগ্ন ছিলাম। তার পরেই একটু হেসে ফেলে বললে, ঘুমিয়ে পড়লেও দোষ নেই রে জলধি, বয়স ত হলো। এখন এইটেই স্বধর্ম।

জলধিও হাসলে, বললে, ইস! ভারী ত বয়েস!

যৌবনের প্রথম দিকটা এককড়ির শেষ হয়–হয়। রগের কাছটায় চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু সুগঠিত দেহে শক্তি ও উদ্যমের অবধি নেই। এককড়ি বিপত্নীক। প্রকাণ্ড বাড়ির মধ্যে আছে শুধু তার বছর-দশেকের মেয়ে আর এক বিধবা পিসী। পাটের ও তিসির ব্যবসায়ে পিতা এত অর্থসম্পদ রেখে গেছেন যে, তাকে প্রভূত বলাও চলে। পরে পরে অনেকগুলি ভাই-বোন মরার পরে এককড়ির জন্ম, তাই ছেলেবেলায় এত সাবধানে তাকে রক্ষা করা হয় যে, সে প্রায় একপ্রকার পাগলামির অন্তর্গত। পিতা স্কুলে পর্যন্ত কখনো ছেলেকে পাঠান নি,—বাড়িতেই নিযুক্ত ছিল মাস্টার ও পন্ডিত, নামজাদা ও উচ্চ বেতনের। ছাত্রের সম্বন্ধে তাদের সার্টিফিকেটের ভাষা ছিল উদার, কিন্তু বিদ্যার পরীক্ষা যাকে দিতে হয়নি তার বাজার-দর কত এবং বাগ্‌দেবী সত্যই তাকে বর দিলেন কি পরিমাণ, এ তথ্য নিরূপণ করা আজ কঠিন। পাঠ সাঙ্গ হ’লো, শিক্ষকগণ বিদায় নিলেন, তবু লাইব্রেরি ঘরেই দিন কাটতো তার এতদিন। পিসীমার বহু অশ্রুপাত অগ্রাহ্য করেও সে যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেনি, বইয়ের শেলফগুলো ছাড়া এ রহস্য আর কেউ জানে না। এমনি করেই তার দিন কাটতে পারতো, কিন্তু পারলো না। হঠাৎ বন্দেমাতরমের বিরাট কঠিন ধ্বনি কোটর থেকে টেনে তাকে বার করলে। তার পরে জেলে গেলো, দলাদলির আবর্তে পড়ে নাকে-মুখে পাঁক ঢুকলো; দৈনিক ও সাপ্তাহিক প্রদত্ত নানা বিচিত্র বিশেষণের মালা শিরোপা পেলে, শেষে একদিন যাদের সংসার চালিয়েছিল তারাই চোর বলে যখন কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলে, তখন সে আর সইলো না, পলিটিক্সে জলাঞ্জলি দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে আবার তার লাইব্রেরি-ঘরে এসে আশ্রয় নিলে।