সাহেব পুনরায় হাসিলেন, কহিলেন—এক হিসেবে সংসারে সবাই ত বেশ থাকে, মা।
ইন্দু বলিল—সে নয়, কাকাবাবু। এক হিসেবে আমাদের চেয়ে এরা ভাল আছে, আমি সেই কথাই বলছি।
বৃদ্ধ ইহার কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—আচ্ছা মা, এদের মত কি তোমরাও এমনিভাবে জীবন যাপন করতে পার?
ইন্দু কহিল—তোমরা আপনি কাদের বলছেন, আমি জানিনে। যদি আলোকে বলে থাকেন ত সে পারে না। যদি আমাকে বলে থাকেন ত আমি বোধ করি পারি।—এই বলিয়া সে মুহূর্তকাল, মৌন থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিতে লাগিল—বাবা-মা আমার ওপরে বেশী খুশী নন, আমাদের সমাজের মেয়েরা লুকিয়ে আমাকে ঠাট্টা-তামাশা করে, কিন্তু কি জানি কাকাবাবু, আমার ভেতরে কি আছে, আমি কিছুতেই তাদের সঙ্গে সমানভাবে মিশতে পারিনে। অনেক সময়েই আমার যেন মনে হয়, যেভাবে আমরা সবাই থাকি, তার বেশীর ভাগই সংসারে নিরর্থক। মা বলেন, সভ্যতার এ-সকল অঙ্গ, সভ্য মানুষের এ-সব অপরিহার্য। কিন্তু আমি বলি, ভালই যখন আমার লাগে না, তখন অত সভ্যতাতেই বা আমার দরকার কিসের?
তাহার কথা শুনিয়া, তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া সাহেব মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, কিছুই বলিলেন না। ইন্দু অযাচিত অনেক কথা বলিয়া ফেলিয়া নিজের প্রগল্ভতায় লজ্জা পাইল। তাহার চৈতন্য হইল যে, সাহেবের মুখের উপর আধুনিক সভ্যতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে যাওয়া ঠিক হয় নাই। এখন কতকটা সামলাইয়া লইবার অভিপ্রায়ে কহিল, যাঁদের এ-সব ভাল লাগে, তাঁদের সম্বন্ধে আমি কিছুই বলিনি, কাকাবাবু। কিন্তু যাঁদের ভাল লাগে না, বরঞ্চ কষ্ট বোধ হয়, তাঁদের এততে দরকার কি? আপনি কিন্তু আমার ওপর রাগ করতে পারবেন না, তা বলে দিচ্ছি।
সাহেব প্রত্যুত্তরে শুধু হাসিমুখে কহিলেন,—না মা, রাগ করিনি।
ইন্দু বলিতে লাগিল—এই যে-সব মেয়েরা সসঙ্কোচে পথের একধারে সরে দাঁড়াচ্ছে, পুরুষরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে কেউ আপনাকে প্রণাম করছে, কেউ সেলাম করছে, এদের সঙ্গে আমাদের কিছুই ত মেলে না, কিন্তু এরা কি সব বর্বর? হ’লই বা খালি গা, খালি পা, তাতে লজ্জা কিসের? পরকে সম্মান দিতে ত এরা আমাদের চেয়ে কম জানে না, কাকাবাবু?