স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন, ওটি ওমুক জীউর মন্দির সম্রাট আওরঙ্গজেব ধ্বংস করিয়াছেন, ওটি ওমুক জীউর মন্দির ওমুক বাদশাহ ভূমিসাৎ করিয়াছেন, ওটি ওমুক দেবায়তন ভাঙ্গিয়া মস্জেদ তৈরি হইয়াছে; ওখানে আর কেন যাইবে, আসল বিগ্রহ নাই,—নূতন গড়াইয়া রাখা হইয়াছে,—ইত্যাদি পুণ্যময় কাহিনীতে চিত্ত একেবারে মধুময় করিয়া আমরা অনেক রাত্রে আশ্রমে ফিরিয়া আসিলাম। পথে সুরেশচন্দ্র নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন,—যাক্, সে অনেককালের কথা।
স্বামীজী কহিলেন, কালের জন্য আসিয়া যায় না সুরেশ, মন্দির ভাঙ্গিয়া মস্জেদ ও বিগ্রহ দিয়া সিঁড়ি তৈরির সুযোগ আর নাই,—এই যা তোমাদের ভরসা। তোমরা কংগ্রেসের দল ইংরাজ-রাজার এই গুণটা অন্ততঃ স্বীকার করো।
এই বৃন্দাবনে এক মারবাড়ী ধনী কানা খোঁড়া কালা অন্ধ খঞ্জ সমস্ত বৈষ্ণবীদেরই বৈকুণ্ঠে চড়িবার এক অদ্ভুত লিফ্ট প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন শুনা গেল। সুরেশচন্দ্র ত এই মারবাড়ীর ধর্মপ্রাণতায়, বুদ্ধির সূক্ষ্মতায় ও ফন্দির অপরূপত্বে একপ্রকার মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। দেখা হওয়া পর্যন্ত ত এই কথাই সে আমাদের এক-শ'বার করিয়া বলিতে লাগিল, এবং পরদিন সকাল হইতে না হইতে আমাদের সে সর্বকর্ম ফেলিয়া সেইদিকে টানিয়া লইয়া গেল। একটা ঘেরা জায়গায় নানা বয়সের শ’-দুই-তিন বৈষ্ণবী সারি দিয়া বসিয়াছে, প্রত্যেকের হাতে এক-এক জোড়া খঞ্জনী। তাহারা সেই বাদ্য-যন্ত্র সহযোগে সুর করিয়া অবিশ্রাম আবৃত্তি করিতেছে—নিতাই গৌর রাধে শ্যাম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম। তাহাদের মাঝখান দিয়া পথ। দুই-তিনজন মারবাড়ী কর্মচারী অনুক্ষণ ঘুরিয়া ঘুরিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিয়াছে—কেহ ফাঁকি না দেয়। এইভাবে প্রত্যহ বেলা এগারোটা পর্যন্ত তাহারা বৈষ্ণবী ধর্ম পালন করিলে আধ সের করিয়া আটা পায়, এবং সন্ধ্যাকালে এইমত রুটিনে পরকালের কাজ করিলে এক আনা করিয়া পয়সা পায়। প্রভাতকাল। জন-দুই বুড়া বৈষ্ণবীর তখন পর্যন্ত ঘুম ছাড়ে নাই, তাহারা ঢুলিতেছিল, একজন আধা-বয়সী বৈষ্ণবী তাহার পাশের বৈষ্ণবীর সহিত চাপা-গলায় তুমুল কলহ করিতেছিল। আমরা হঠাৎ প্রবেশ করিতেই বৃদ্ধা দুইটি চমকিয়া উঠিয়া নামগান শুরু করিল এবং যাহারা বিবাদ করিতে ব্যস্ত ছিল, তাহাদের অসমাপ্ত কোন্দল এইপ্রকার আকস্মিক বাধায় বুকের মধ্যে যেন পাক খাইয়া ফিরিতে লাগিল। বিরক্তি ও ক্রোধে মুখ তাহাদের কালো হইয়া উঠিল।