এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা  :  ক্ষুদ্রের গৌরব         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 5
অন্যের তাহাতে স্থান হয় না, তাহাই সদানন্দের অশ্রুজলের কারণ, আকর, মূল,—কিন্তু সোপান বা পথ নহে। অগাধ সমুদ্র ঝঞ্ঝাবাতের সহিত যুদ্ধ করে, কিন্তু ঘোষণা করিয়া বেড়ায় না! শুধু ক্ষুদ্র তরঙ্গের দল তটপ্রান্তে আসিয়া ঘাতপ্রতিঘাতে পৃথিবীর বক্ষঃস্থল পর্যন্ত কম্পিত করিয়া বলিয়া যায়—“দেখ আমাদের কত প্রতাপ!” কূপের জল তাহা পারে না। সাগর-ঊর্মির ইহাই গর্ব যে সে অগাধ শক্তিশালী সমুদ্রের আশ্রিত। সূর্যের তেজ জননী বসুমতী প্রতিফলিত করেন, তাই তাঁহার রুদ্র প্রতাপ বুঝিতে পারি। আর সেই অনন্ত জ্যোতির্ময়ী বিশ্বপ্লাবনী রাধাপ্রেমের কথা বৃন্দা, ললিতা, বিশাখা, প্রভৃতি সখিবৃন্দ ব্যতীত আর কেহ জানিত না। যাহারা জানিতে পারিয়াছিল তাহারা মহৎ হইয়াছিল, যাহারা শুনিয়াছিল তাহারা ধন্য হইয়াছিল। তার পর কালক্রমে লোকে হয়ত সে কথা ভুলিয়া যাইত। একেবারে না ভুলিলেও তাহাতে এমন জীবন্ত মোহিনীশক্তি থাকিত না। এ মাধুরী যাঁহারা ধরিয়া রাখিয়াছেন, এ মহত্ত্ব, নশ্বর জগতের এ-সার বস্তু যাঁহারা পৃথিবীর ন্যায় প্রতিফলিত করিয়া জনসাধারণকে উচ্চে তুলিয়াছেন,—তাঁহারা, ঐ অজর চিরপ্রিয় বৈষ্ণব কবিগণ। সে রাধাপ্রেমের ছায়া তাঁহারা হৃদয়ে ধরিতে পারিয়াছিলেন এবং সরস প্রেমপূর্ণ সুধামাখা ছন্দোবন্ধে জগৎসমক্ষে প্রতিভাত করিয়াছিলেন।

স্বর্গীয় বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর কহিয়াছেন—“এ জগতে বিশেষণের বাহুল্য”। এ কথা বড় সত্য। বিশেষণ না থাকিলে বিশেষ্যকে কে চিনিত! তাই মনে হয়, এই অমর কবিতাগুলি রাধাপ্রেমের বিশেষণ ভিন্ন আর কিছুই নহে। যাহাকে দেখিলে তাহার বিশেষ্যকে মনে পড়ে, বিশেষ্যের সেইটিই বিশেষণ, সেইটিই প্রতিবিম্ব, সেইটিই ছায়া।

যে বিরহ—শোকগাথা গাহিয়া অতীত দিবসের বৈষ্ণব-কবিগণ আপামর সকলকে উন্মত্ত করিয়াছিলেন, তাহারই একটি হস্তপদহীন পরিত্যক্ত মৃৎপুত্তলিকার মত, মৃত পুত্রের ছায়ার মত, এই ক্ষুদ্র, “যমুনা-পুলিনে বসে কাঁদে রাধা বিনোদিনী” পদটি সদানন্দের অশ্রু টানিয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছিল। ক্ষুদ্র কবির ইহাই গৌরব,—ক্ষুদ্র কবিতার ইহাই মহত্ত্ব। ক্ষুদ্র ছায়া সদানন্দকে বশ করিতে পারিবে, কিন্তু রোহিণীকুমারের নিকটেও হয়ত যাইতে পারিবে না। তাহাতে ছায়ার অপরাধ কি?