আমার বাল্যকালের কথা মনে পড়ে। প্রতি সাহিত্য-সাধকের অন্তরেই পাশাপাশি বাস করে দু’জনে; তার একজন হলো লেখক, সে করে সৃষ্টি, আর অন্যজন হলো তার সমালোচক, সে করে বিচার। অল্পবয়সে লেখক থাকে প্রবল পক্ষ,—অপরকে সে মানতে চায় না। একজন পদে পদে যতই হাত চেপে ধরতে চায়, কানে কানে বলতে থাকে,—পাগলের মতো লিখে যাচ্ছো কি, থামো একটুখানি,—প্রবল পক্ষ ততই সবলে হাত-দুটো তার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চালিয়ে যায় তার নিরঙ্কুশ রচনা। বলে, আজ ত আমার থামবার দিন নয়,—আজ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের গতিবেগে ছুটে চলার দিন। সেদিন খাতার পাতায় পুঁজি হয় বেশী, স্পর্ধা হয়ে ওঠে অভ্রভেদী। সেদিন ভিত থাকে কাঁচা, কল্পনা হয় অসংযত উদ্দাম; মোটা গলায় চেঁচিয়ে বলাটাকেই সেদিন যুক্তি বলে ভ্রম হয়। সেদিন বইয়ে-পড়া ভালো-লাগা চরিত্রের পরিস্ফীত বিকৃতিকেই সদম্ভে প্রকাশ করাকে মনে হয় যেন নিজেরই অনবদ্য মৌলিক সৃষ্টি।
হয়ত, সাহিত্য-সাধনায় এইটিই হচ্ছে স্বাভাবিক বিধি; কিন্তু উত্তরকালে এর জন্যই যে লজ্জা রাখার ঠাঁই মেলে না, এ-ও বোধ করি এর এমনিই অপরিহার্য অঙ্গ। আমার প্রথম যৌবনের কত রচনাকেই না এই পর্যায়ে ফেলা যায়।
কিন্তু ভাগ্য ভাল, ভুল আমার আপনার কাছেই ধরা পড়ে। আমি সভয়ে নীরব হয়ে যাই। তারপরে দীর্ঘদিন নিঃশব্দে কাটে। কেমন করে কাটে, সে বিবরণ অবান্তর। কিন্তু বাণীর মন্দির-দ্বারে আবার যখন ফিরিয়ে এনে আত্মীয়-বন্ধুরা দাঁড় করিয়ে দিলেন, তখন যৌবন গেছে শেষ হয়ে, ঝড় এসেচে থেমে, তখন জানতে বাকী নেই সংসারে সংঘটিত ঘটনাই কেবল সাহিত্যে সত্য নয়, এবং সত্য বলেই তা সাহিত্যের উপাদানও নয়। ওরা শুধু ভিত্তি এবং ভিত্তি বলেই থাকে মাটির নীচে সঙ্গোপনে—থাকে অন্তরালে।
তখন আমার আপন বিচারক বসেচে তার সুনির্দিষ্ট আসনে; আমার যে-আমি লেখক, সে নিয়েচে তার শাসন মেনে। এদের বিবাদের হয়েচে অবসান।