অতএব দশ হাতের বদলে পাঁচ হাত কাপড় এবং পাঁচ হাতের বদলে কৌপীন পরিধান—এবং যেহেতু বিলাসিতা পাপ, সেই হেতু সর্বপ্রকার কৃচ্ছ্রসাধনই মনুষ্যত্ব-বিকাশের সর্বোত্তম উপায়। এই পুণ্যভূমি ত্যাগ-মাহাত্ম্যেই ভরপুর। উচ্চাঙ্গের দর্শনশাস্ত্রে কি আছে জানিনে, কিন্তু সহজ বুদ্ধিতে মনে হয়, এই ত্যাগের মন্ত্র দিনের পর দিন সর্বসাধারণকে মানুষের ধাপ থেকে নামিয়ে পশুর কোঠায় টেনে এনেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা করবে কি, অভাব-বোধটাই তাদের শুকিয়ে গেছে। ছোট জাত অস্পৃশ্য—তাতে কি ? ভগবান করেছেন! একবেলার বেশী অন্ন জোটে না,— কপালের লেখা! এতে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। যারা আর একটু বেশী জানে, তারা উদাস চক্ষে চেয়ে বলে, সংসার ত মায়া,—দু’দিনের খেলা; এ-জন্মে সন্তুষ্টচিত্তে দুঃখ সয়ে গেলে আর-জন্মে মুখ তুলে চাবেন। এক অদৃষ্ট ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে তাদের নালিশ নেই। চাইতে তারা জানে না, চাইতে তারা ভয় পায়। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, শক্তি নেই, স্বাস্থ্য নেই, অভাবের পরে অভাব নিরন্তর যতই চেপে বসে, ততই তারা সহ্য করার বর প্রার্থনা করে। তাতেও যখন কুলোয় না, তখন আকাশের পানে চেয়ে নিঃশব্দে চোখ বোজে।
একটা কথা পুরানো-পন্থীদের মুখে দুঃখ করে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, সেকালে এমনটি ছিল না। এখন চাষারা পর্যন্ত জামা পরে, পায়ে জুতো দিতে চায়, মাথায় ছাতা ধরে, তাদের মেয়েরা গায়ে সাবান মাখে, বাবুয়ানিতে দেশটা উচ্ছন্নে গেল। প্রত্যুত্তরে তাদের এই কথাই তোমাদের বলা চাই যে, এই যদি সত্য হয় ত আনন্দের কথা। দেশ উচ্ছন্ন না গিয়ে উন্নতির দিকে মুখ ফিরিয়েছে, তারই আভাস দেখা দিয়েছে। মানুষ যত চায়, ততই তার পাবার শক্তি বাড়ে। অভাব জয় করাই জীবনের সফলতা — তাকে স্বীকার করে তার গোলামি করাটাই কাপুরুষতা। একদিন যা ছিল না, তাকে অহেতুক বাবুয়ানি বলে ধিক্কার দিয়ে বেড়ানোই দেশের কল্যাণ কামনা নয়।
বিগত ডিসেম্বরে কলকাতায় আহূত All India Youth League-সম্মিলনের সভাপতি শ্রীযুক্ত নরিম্যান সাহেবের বক্তৃতার একটা স্থান আমি উল্লেখ করতে চাই। তিনি উচ্ছ্বসিত আবেগে বার বার এই কথাটা বলেছিলেন যে বারদোলীতে ইংরেজ-শাসনদণ্ডকে আমরা ভূমিসাৎ করে দিয়েছি! ব্রিটিশসিংহ লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারছে না। এতএব Bardolise the whole Country। বারদোলীর গৌরবহানি করবার সংকল্প আমার নেই, এবং ওরা যে সাহসী এবং দৃঢ়চিত্ত এবং বড় কাজই করেছে তা সম্পূর্ণ স্বীকার করি। কিন্তু ঠিক এমনি কাজ যদি কখনও তোমাদের বাঙ্গালার করতে হয় ত কোরো, কিন্তু পশ্চিম ভারতের কংগ্রেস নেতাদের মত পৃথিবীময় অমন তাল ঠুকে ঠুকে বেড়িয়ো না। একটুখানি বিনয় ভালো। ব্যাপারটা কি হয়েছিল সংক্ষেপে বলি। প্রজারা বললে, “হুজুর, এক টাকার খাজনা দু’টাকা হয়ে গেছে, আমরা আর দিতে পারব না— মারা যাব। সত্য কিনা খোঁজ করুন।” অবিবেচক রাজকর্মচারী বললে, “না, সে হবে না।