দয়াল। কন্যা সম্প্রদান করতে বসেছেন তাঁর দূর-সম্পর্কের এক পিসী—
জনৈক ভদ্রলোক। কে—কে? ঈশ্বরকালী ঘোষালের বিধবা?
দয়াল। হাঁ তিনিই। ক্লেশের সঙ্গে মনে হয় আজ বনমালীবাবু যদি জীবিত থাকতেন | তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়াকে নরেন্দ্রনাথের হাতে সমর্পণ করবেন বলেই নরেনকে তিনি মানুষ করে তুলেছিলেন। দয়াময়ের আশীর্বাদে সে মানুষ হয়ে উঠেছে। তাঁর সেই মানুষ-করা ধনের হাতেই তাঁর কন্যাকে আমরা অর্পণ করলুম। বনমালীর অভিলাষ আজ পূর্ণ হলো।
সকলে। আমরা আবার আশীর্বাদ করি তারা সুখী হোক।
[অন্তঃপুর হইতে শঙ্খধ্বনি ও আনন্দ-কলরোল শুনা গেল]
দয়াল। (চোখ বুজিয়া) আমিও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের শুভ ইচ্ছা সফল হয় যেন।
জনৈক বৃদ্ধ। আমরা আপনাকেও আশীর্বাদ করি দয়ালবাবু। শুনেছিলুম রাসবিহারীর ছেলে বিলাসের সঙ্গে হবে বিজয়ার বিবাহ। আমরা প্রজা, শুনে ভয়ে মরে যাই। সে যে কিরূপ পাষণ্ড—
দয়াল। (সলজ্জে হাত তুলিয়া) না না না,—অমন কথা বলবেন না মজুমদারমশাই। প্রার্থনা করি তাঁরও মঙ্গল হোক।
বৃদ্ধ। মঙ্গল হবে? ছাই হবে। গোল্লায় যাবে। আমার পুকুরটার—
দয়াল। না না না না,—ও-কথা বলতে নেই—বলতে নেই—কারো সম্বন্ধে না। করুণাময় যেন সকলেরই মঙ্গল করেন।
বৃদ্ধ। কিন্তু ঐ যে বুড়ো দেড়ে—
[ধীরে গম্ভীরপদে রাসবিহারী প্রবেশ করিতেই
সকলে চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইয়া—]
সকলে। আসুন, আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক রাসবিহারীবাবু। আমরা সকলেই আপনার শুভাগমনের প্রতীক্ষা করছিলুম।
রাস। (কটাক্ষে চাহিয়া, দয়ালের প্রতি) আজ ব্যাপারটা কি বল ত দয়াল? দোরগোড়ায় কলাগাছ পুঁতেছ, ঘট বসিয়েছ, বাড়ির ভেতরে শাঁকের আওয়াজ শুনতে পেলুম,—আয়োজন মন্দ করোনি—কিন্তু কিসের শুনি?
দয়াল। (সভয়ে ও সবিনয়ে) আজ যে বিজয়ার বিবাহ ভাই!
রাস। মতলবটা কে দিলে শুনি?
দয়াল। কেউ নয় ভাই, করুণাময়ের—
রাস। হুঁ—করুণাময়ের! পাত্রটি কে? জগদীশের ছেলে সেই নরেন?
দয়াল। তুমি ত—আপনি ত জানেন বনমালীবাবু চিরদিনের ইচ্ছে ছিল—
রাস। হুঁ, জানি বৈ কি। বনমালীর মেয়ের বিয়ে কি শেষকালে হিন্দুমতেই দিলে নাকি?
দয়াল। আপনি ত জানেন, আসলে সব বিবাহ-অনুষ্ঠানই এক।
রাস। ওর বাপকে যে হিঁদুরা দেশ থেকে তাড়িয়েছিল মেয়েটা তা-ও ভুললো নাকি!
[এমনি সময়ে অন্তঃপুরের নানাবিধ কলরব শঙ্খধ্বনি কানে আসিতে লাগিল]
দয়াল। শুভকার্য নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে। আজ মনের মধ্যে কোন গ্লানি না রেখে তাদের আশীর্বাদ কর ভাই, তারা যেন সুখী হয়, ধর্মশীল হয়, দীর্ঘায়ুঃ হয়।
রাস। হুঁ। আমাকে বললেই পারতে দয়াল, তা হলে ছল-চাতুরি করতে হতো না। ওতেই আমার সবচেয়ে ঘৃণা।
[এই বলিয়া তিনি গমনোদ্যত হইলেন। নলিনী
কোথায় ছিল ছুটিয়া আসিয়া পড়িল]