বিন্দু চেঁচামেচি করিয়া কাহাকেও ডাকিল না—তাহার মাথা কোলে করিয়া বসিয়া নিঃশব্দে পাখার বাতাস করিতে লাগিল। এই মেয়েটির স্বাভাবিক ধৈর্য যে কত বড়, সে পরীক্ষা তাহার স্বামীর পীড়ার সময়েই হইয়া গিয়াছিল। মৃত্যু যাহার স্বামীর শিয়রে আসিয়া বসিয়াও তাহাকে বিচলিত করিতে পারে নাই, এখন কমলার জন্যও সে অস্থির হইয়া উঠিল না। কিছুক্ষণে সংজ্ঞা পাইয়া কমলা চোখ মেলিয়া একবার চাহিয়া দেখিল, সে কোথায় আছে;
তাহার পর সেই কোলের উপরেই উপুড় হইয়া পড়িয়া প্রাণপণে নিজের বুক চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল।
সে ক্রন্দন এত গাঢ়, এত গুরুভার যে, তাহা বিন্দুর ক্রোড়ের মধ্যেই শুকাইয়া জমাট বাঁধিয়া যাইতে লাগিল। তাহার একবিন্দু তরঙ্গও ঘরের বাহিরে কাহারও কানে পৌঁছিল না। নির্জন বাহিরে রাত্রির আঁধার নিঃশব্দে গাঢ়তর হইয়া উঠিতে লাগিল, শুধু এই স্বল্পালোকিত কক্ষের মধ্যে এই দুটি তরুণী রমণী, একজন তাহার বিদীর্ণ বক্ষের সমস্ত জ্বালা আর একজনের গভীর-শান্ত ক্রোড়ের মধ্যে নিঃশেষ করিয়া ঢালিয়া দিতে লাগিল।
ক্রমশঃ শান্ত হইয়া কমলা স্বামীর সম্বন্ধে অনেক প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কেন যে নিজে গিয়া তাঁহাকে দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল না, তাহা বিন্দু কিছুতেই ভাবিয়া পায় নাই। একবার এমনও ভাবিবার চেষ্টা করিয়াছিল, হয়ত বড়লোকদের এমনই শিক্ষা এবং সংস্কার। সেবা-শুশ্রূষার ভার চাকর-দাসীদের উপর দিয়া বাহির হইতে খবর লওয়াই তাহাদের নিয়ম।
হঠাৎ কমলা জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ঠাকুরঝি, তোমার দাদার জ্ঞান হলে আমাকে কি একবারও খোঁজ করেননি?
একবার করেছিলেন, বলিয়াই বিন্দু হঠাৎ থামিয়া গেল? কমলা তাহা লক্ষ্য করিল, কিন্তু প্রশ্ন না করিয়া শুধু উৎসুক ব্যাকুল-দৃষ্টিতে বিন্দুর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।
বিন্দু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, দাদার জ্ঞান হলে তিনি আমাকে তুমি মনে করে গলা ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন—বল কমলা, এ-কাজ তুমি করনি? আমি মরেও সুখ পাব না কমলা, শুধু একবার বল, এ-কাজ তোমার দ্বারা হয়নি?
কমলা নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া কহিল, তার পরে?
বিন্দু কহিল, আমি ত জানিনে বৌ, তিনি কোন্ কথা জানতে চেয়েছিলেন।
আমি জানি ঠাকুরঝি, তিনি কি জানতে চান, বলিয়া কমলা একেবারে সোজা উঠিয়া বসিল।
বিন্দু কমলার হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, তুমি সে ঘরে যেয়ো না বৌ।
কেন যাব না?
ডাক্তার নিষেধ করেছিলেন, তুমি গেলে ক্ষতি হতে পারে।
আমার ক্ষতি আমার চেয়ে ডাক্তার বেশি বোঝে না ঠাকুরঝি, আমি তাঁর কাছেই চললুম; ঘুম ভেঙ্গে আবার যদি জানতে চান, আমাকে ত তার জবাব দিতে হবে? বলিয়া কমলা বিন্দুর হাতটা হাতের মধ্যে লইয়া বিনীত-কন্ঠে কহিল, আমি মাথা সোজা রেখে চলতে পারব না বোন, আমাকে দয়া করে একবার তাঁর কাছে দিয়ে এস ঠাকুরঝি।
মনে মনে কহিল, ভগবান, হাতের নোয়া যদি এখনো বজায় রেখেচ ঠাকুর, তা হলে সত্যি-মিথ্যের বিচার করে আর তা কেড়ে নিয়ো না। দণ্ড আমার গেছে কোথায়—সে ত সমস্তই তোলা রইল। শুধু এই করো প্রভু, তোমার সমস্ত কঠিন শাস্তি যাতে হাসিমুখে মাথায় তুলে নিতে পারি, আমার সেই পথটুকু ঘুচিয়ে দিয়ো না।