এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

গল্প  :  রামের সুমতি         
পরিচ্ছেদ: / 5
পৃষ্ঠা: / 28
পাঁচ

পরদিন সকাল হইতে রামের কথাবার্তা বদলাইয়া গেল। সম্পূর্ণ দুইটা দিন কাটিয়া গিয়াছে, বৌদিদি ডাকে নাই, বকে নাই, খাইতে দেয় নাই, এ-রকম সে তাহার জ্ঞানে দেখে নাই। আজ সে বাস্তবিক ভয় পাইয়াছিল। প্রথমটা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া সে নানারূপ উলটা-পালটা জবাবদিহি করিল। একবার বলিল, বেড়াল মারিতে পিয়ারা ছুড়িয়াছিল; একবার বলিল, হাত ফসকাইয়া পড়িয়া গিয়া বৌদির কপালে লাগিয়াছিল; একবার বলিল, কাঁচা পিয়ারা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিল। তার পর একবার বলিল, কাহাকেও সে গাল দেয় নাই; একবার বলিল, গোবিন্দকে দিয়াছিল; একবার বলিল, ভোলাকে দিয়াছিল। কিন্তু কোন কৈফিয়তেই কাজ হইল না। ও-ধারের কেহ জবাব দিল না, প্রতিবাদ করিল না, হাঁ, না একটা কথাও বলিল না। একবার বহু কষ্টে লজ্জা-সঙ্কোচ ত্যাগ করিয়া 'আর কোনদিন করব না' বলিয়া ফেলিয়াও যখন ফল হইল না, তখন সে চুপ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। কি উপায়ে কি দিয়া কেমন করিয়া সে বৌদিকে প্রসন্ন করিবে? বৌদিরা তাহাকে আলাদা করিয়া দিয়াছে, তবে কোথায় সে খাইবে? কাহার কাছে কেমন করিয়া সে থাকিবে? কোন দিকেই আজ সে কূল-কিনারা দেখিতে পাইল না। আজ সে রাঁধিবার চেষ্টা করিল না, পড়িতে গেল না, ঘরে গিয়া শুইয়া রহিল।

গোপনে কাঁদিয়া কাঁদিয়াই বোধ করি, গত রাত্রে নারায়ণীর জ্বর আসিয়াছিল। দুপুরবেলা দিগম্বরী এক বাটি দুধ আনিয়া বলিলেন, খেতেই হবে। না খেয়ে কি মরবি? নারায়ণী প্রতিবাদ না করিয়া দুধের বাটি হাতে লইয়া কতকটা খাইয়া বাটিটা নামাইয়া রাখিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন। তাঁহার 'না, না' করিয়া কথা কাটাকাটি করিতে ঘৃণা বোধ হইল।

রাত্রি যখন নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, তখন নেত্য আসিয়া চুপি চুপি বলিল, মা, ছোটবাবুর ত কোন সাড়াশব্দ পাইনে—রাত ত ঢের হ'ল!

নারায়ণী উদ্বেগে উঠিয়া বসিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, লক্ষ্মী মা আমার, দেখে আয়, সে ঘরে আছে কিনা।

নেত্যর চোখ ভিজিয়া উঠিল। হাত দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, আমার যেতে সাহস হয় না মা! বলিয়া বাহিরে গিয়া ভোলাকে সে ডাকিয়া আনিল। ভোলা সংবাদ দিল—দাঠাকুর ঘরে আছে, ঘুমুচ্ছে।

নারায়ণী নিঃশদ্বে দুই হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া চাদর মুড়ি দিয়া আবার শুইয়া পড়িলেন। পরদিন প্রভাত না হইতেই তিনি স্নান করিয়া আসিয়া রান্না চড়াইয়া দিলেন।

রান্না যখন প্রায় অর্ধেক অগ্রসর হইয়াছে, তখন দিগম্বরী গাত্রোত্থান করিয়া ব্যাপার দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কর্কশ-স্বরে প্রশ্ন করিলেন, তোর না জ্বর নারাণি? তুই না তিন দিন খাসনি? ভোরবেলা উঠে চান করে এসে এ-সব কি হচ্ছে, জিজ্ঞেস করি?

নারায়ণী স্বাভাবিক মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, রাঁধচি, দেখতে ত পাচ্চ।

তা ত পাচ্চি, কিন্তু কেন? কেন শুনি? তুই কি আমার হাতে খাবিনি?

নারায়ণী জবাব দিলেন না, কাজ করিতে লাগিলেন।

কাল সমস্ত দিন ধরিয়া রাম এই একটা কথা ভাবিতেছিল,—বৌদিদির না জানি কত লাগিয়াছে! একটা কাঁচা পিয়ারা লইয়া বার বার কপালের উপর ঠুকিয়া সে আঘাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিয়া, শেষে ভাবিতে বসিয়াছিল, কি করিলে এই কুকর্মটা মুছিয়া ফেলিতে পারা যায়।