এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব)         
পরিচ্ছেদ: / 14
পৃষ্ঠা: / 134
চৌদ্দ

সমস্ত পথ চোখ যাহাকে অন্ধকারেও খুঁজিতেছিল, তাহার দেখা পাইলাম রেলওয়ে স্টেশনে। লোকের ভিড় হইতে দূরে দাঁড়াইয়া আছে, আমাকে দেখিয়া কাছে আসিয়া বলিল, একখানি টিকিট কিনে দিতে হবে গোঁসাই—

সত্যিই কি তবে সকলকে ছেড়ে চললে?

এ-ছাড়া ত আর উপায় নেই।

কষ্ট হয় না কমললতা?

এ কথা কেন জিজ্ঞাসা করো গোঁসাই, জানো ত সব।

কোথায় যাবে?

যাব বৃন্দাবনে। কিন্তু অত দুরের টিকিট চাইনে—তুমি কাছাকাছি কোন-একটা জায়গার কিনে দাও।

অর্থাৎ আমার ঋণ যত কম হয়। তার পরে শুধু হবে পরের কাছে ভিক্ষে, যতদিন না পথ শেষ হয়। এই ত?

ভিক্ষে কি এই প্রথম শুরু হবে গোঁসাই? আর কি কখনো করিনি?

চুপ করিয়া রহিলাম। সে আমার পানে চাহিয়াই চোখ ফিরাইয়া লইল, কহিল, দাও বৃন্দাবনেরই টিকিট কিনে।

তবে চল একসঙ্গে যাই।

তোমারো কি ঐ এক পথ নাকি?

বলিলাম, না, এক নয়, তবু যতটুকু এক করে নিতে পারি।

গাড়ি আসিলে দু’জনে উঠিয়া বসিলাম। পাশের বেঞ্চে নিজের হাতে তাহার বিছানা করিয়া দিলাম।

কমললতা ব্যস্ত হইয়া উঠিল—ও কি করচ গোঁসাই?

করচি যা কখনো কারো জন্যে করিনি—চিরদিন মনে থাকবে বলে।

সত্যিই কি মনে রাখতে চাও?

সত্যিই মনে রাখতে চাই কমললতা। তুমি ছাড়া যে-কথা আর কেউ জানবে না।

কিন্তু আমার যে অপরাধ হবে, গোঁসাই।

না, অপরাধ হবে না—তুমি স্বচ্ছন্দে ব'সো।

কমললতা বসিল, কিন্তু বড় সঙ্কোচের সহিত। গাড়ি চলিতে লাগিল কত গ্রাম, কত নগর, কত প্রান্তর পার হইয়া—অদূরে বসিয়া সে ধীরে ধীরে তাহার জীবনের কত কাহিনীই বলিতে লাগিল। তাহার পথে বেড়ানর কথা, তাহার মথুরা, বৃন্দাবন, গোবর্ধন, রাধাকুণ্ডবাসের কথা, কত তীর্থভ্রমণের গল্প, শেষে দ্বারিকাদাসের আশ্রমে, মুরারিপুর আশ্রমে আসা। আমার মনে পড়িয়া গেল ঐ লোকটির বিদায়কালের কথাগুলি; বলিলাম, জানো কমললতা, বড়গোঁসাই তোমার কলঙ্ক বিশ্বাস করেন না।

করেন না?

একেবারে না। আমার আসবার সময়ে তাঁর চোখে জল পড়তে লাগল, বললেন, নির্দোষীকে দূর করে যদি নিজে থাকি নতুনগোঁসাই, মিথ্যে তাঁর নাম নেওয়া, মিথ্যে আমার এ-পথে আসা। মঠে তিনিও থাকবেন না কমললতা, এমন নিষ্পাপ মধুর আশ্রমটি একেবারে ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে যাবে।