বলিলাম, তুমি নাহয় স্থির হলে, কিন্তু আমাকে যে ভয়ানক অস্থির করে তুললে। এখনি সবাই এসে পড়বে, তখন তুমিই বা মুখে দেখাবে কি করে, আর আমিই বা জবাব দেব কি!
রাজলক্ষ্মী প্রত্যুত্তরে শুধু আর-একবার ললাট স্পর্শ করিয়া কহিল, জবাব আর কি দেবে—আমার অদৃষ্ট!
তাহার উপেক্ষা এবং ঔদাসীন্যে নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া বলিলাম, অদৃষ্টই বটে! কিন্তু লজ্জা-সরমের মাথা কি একেবারে খেয়ে বসে আছো? এখানে মুখ দেখাতেও তোমার বাধলো না?
রাজলক্ষ্মী তেমনি উদাসকণ্ঠে উত্তর দিল, লজ্জা-সরম আমার যা কিছু এখন সব তুমি।
ইহার পরে আবার বলিবই বা কি, শুনিবই বা কি! চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিলাম।
খানিক পরে জিজ্ঞাসা কহিলাম, বঙ্কুর বিয়ে নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে?
রাজলক্ষ্মী কহিল, হাঁ।
এখন কোথা থেকে আসচো? কলকাতা থেকে?
না, পাটনা থেকে। সেইখানেই তোমার চিঠি পেয়েচি।
আমাকে নিয়ে যাবে কোথায়?—পাটনায়?
রাজলক্ষ্মী একটু ভাবিয়া কহিল, একবার সেখানে ত তোমাকে যেতেই হবে। আগে কলকাতায় যাই চল, সেখানে দেখিয়ে শুনিয়ে ভাল হলে—তারপরে—
প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু তার পরেই বা আমাকে পাটনায় যেতে হবে কেন শুনি!
রাজলক্ষ্মী কহিল, দানপত্র ত সেখানেই রেজেস্ট্রী করতে হবে। লেখাপড়া সব একরকম ক’রে রেখেই এসেচি বটে, কিন্তু তোমার হুকুম ছাড়া ত হতে পারবে না।
অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়াও জিজ্ঞাসা করিলাম, কিসের দানপত্র? কাকে কি দিলে?
রাজলক্ষ্মী কহিল, বাড়ি-দুটো ত বঙ্কুকেই দিয়েচি। শুধু কাশীর বাড়িটা গুরুদেবকে দেব ভেবেচি। আর কোম্পানির কাগজ, গয়না-টয়নাগুলো ত আমার বুদ্ধি-বিবেচনামত একরকম ভাগ করে এসেচি, এখন শুধু তুমি বললেই—
বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। কহিলাম, তা হলে তোমার নিজের রইল কি? বঙ্কু যদি তোমার ভার না নেয়? এখন তার নিজের সংসার হ’লো, যদি সে শেষে তোমাকেই খেতে না দেয়?
আমি কি তাই চাইচি নাকি? নিজের সমস্ত দান ক’রে কি অবশেষে তারই হাত-তোলা খেয়ে থাকবো? তুমি ত বেশ!
অধৈর্য আর সংবরণ করিতে না পারিয়া উঠিয়া বসিয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলিয়া উঠিলাম, হরিশ্চন্দ্রের মত এ দুর্বুদ্ধি তোমাকে দিলে কে? খাবে কি? বুড়ো বয়সে কার গলগ্রহ হতে যাবে?