কিন্তু দেশোদ্ধারের নেশা তখন পাকা করে ধরেচে, তাই পুরোনো বইয়ের মধ্যে আর তার মৌতাতের খোরাক মিললো না, আবার তাকে অস্থির করে তুললে। এবার কতকগুলি ছেলেমেয়ে জুটলো—তারাও তখন পলিটিক্সে তোবা করে বেকার হয়ে পড়েচে—বললে, এককড়িদা, রাজনীতি আর না, কিন্তু জীবনটাকে কি নিতান্তই ব্যর্থ করে আনবো, দেশের একটা কাজেও লাগবে না? এ দুর্গতি থেকে বাঁচাও—যাতে হোক লাগিয়ে আমাদের দিয়ে তুমি কাজ করিয়ে নাও।
এককড়ি রাজী হ’লো। স্থির হ’লো এবারের প্রোগ্রাম সোশাল সার্ভিস। গ্রামে, নগরে, পল্লীতে—সর্বত্র কেন্দ্র সংস্থাপন করা। জলধি বললে, বিদ্যায়, জ্ঞানে, চরিত্রে, অর্জনে, সঞ্চয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে সচেতন করতে না পারলে ঘরে-পরে কেবল বিদ্বেষ আর কলহ দিয়েই সঙ্কট মোচন হবে না। যোগ্য না হলে যোগ্যতার পুরস্কার পাবে কার কাছে? পেলেই বা থাকবে কেন? ধনীর কুপুত্রের মতো বিত্ত-সম্পদ যে দেখতে দেখতে লোপ পাবে—চক্ষের পলক সইবে না,—কমলা অন্তর্হিত হবেন। এ-সব যুক্তি শাশ্বত সত্য—অকাট্য। এর বিরুদ্ধে তর্ক চলে না।
অতএব প্রতিষ্ঠিত হলো কল্যাণ-সঙ্ঘ। গ্রামে গ্রামে প্রসারিত হলো শাখা-প্রশাখা। অধ্যক্ষ এককড়ি, সচিব জলধি। নানা শাখার সদস্য সংখ্যা দু'শোর বেশী। আজকের দিনে মাসিক অধিবেশনের বৈঠকে সাধারনতঃ হাজির যারা হয় সেও জন-পঞ্চাশের কম নয়। দূরের সদস্যদের ট্রেনভাড়া দেবার ব্যবস্থা আছে।
নীচের যে ঘরটায় সঙ্ঘের অফিস সেখানে বসে যে মেয়েটি অবিশ্রাম কেরানীর কাজ করে তার নাম মণিমালা। মাসিক ত্রিশ টাকায় সে ভর্তি হয়, সম্প্রতি খুশি হয়ে এককড়ি মাইনে বাড়িয়েছে পঞ্চাশ টাকায়। গোড়ায় এককড়ি তাকে বাড়িতে থাকতেই বলেছিল, কারণ ঘরের অভাব নেই, কিন্তু সে রাজী হয়নি। কাছেই কোথায় তার বাসা—সেখানে নিজে রেঁধে খায়। একলা থাকে। একটা দিনের জন্যে তার কামাই নেই, একটা কাজে তার শৈথিল্য প্রকাশ পায় না। একদা অসহযোগের প্রবল বন্যায় ভাসতে ভাসতে ঠেকতে ঠেকতে সে এ-অঞ্চলে এসে পড়ে। সঙ্গে বাবা ছিলেন, কিন্তু বুড়ো বয়সে জেলের দুঃখ তাঁর সইলো না—বাইরে এসে যশোর না কোথায় উদরাময়ে মারা গেলেন। মণিমালার প্রাক্তন ইতিবৃত্ত এর বেশী কেউ জানে না। স্বল্পভাষী মেয়ে,—নিজের মুখে প্রায়ই কিছু বলে না। দেখতে সে সুন্দরী নয়, মুখের ’পরে একটা পুরুষালি ভাব, কাউকে টানে, কাউকে দূরে ঠেলে।