এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা  :  সমাজ-ধর্মের মূল্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 19
যাহা হউক, কথাটা মিথ্যা নয় যে, সামাজিক আইন বা রাজার আইন চিরদিন এমনি করিয়াই প্রসারিত হইয়াছে এবং হইতেছে। কিন্তু যতক্ষণ তাহা না হইতেছে, ততক্ষণ সমাজ যদি তাহার শাস্ত্র বা অন্যায় দেশাচারে কাহাকেও ক্লেশ দিতেই বাধ্য হয়, তাহার সংশোধন না করা পর্যন্ত এই অন্যায়ের পদতলে নিজের ন্যায্য দাবী বা স্বার্থ বলি দেওয়ায় যে কোন পৌরুষ নাই, তাহাতে যে কোন মঙ্গল হয় না, এমন কথাও ত জোর করিয়া বলা চলে না।

কথাটা শুনিতে হয়ত কতকটা হেঁয়ালির মত হইল। পরে তাহাকে পরিস্ফুট করিতে যত্ন করিব। কিন্তু এইখানে একটা মোটা কথা বলিয়া রাখি যে, রাজশক্তির বিপক্ষে বিদ্রোহ করিয়া তাহার বল ক্ষয় করিয়া তোলায় যেমন দেশের মঙ্গল নাই—একটা ভালর জন্য অনেক ভাল তাহাতে যেমন বিপর্যস্ত, লণ্ডভণ্ড হইয়া যায়, সমাজ-শক্তির সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথাই খাটে। এই কথাটা কোনমতেই ভোলা চলে না যে, প্রতিবাদ এক বস্তু, কিন্তু বিদ্রোহ সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। বিদ্রোহকে চরম প্রতিবাদ বলিয়া কৈফিয়ত দেওয়া যায় না। কারণ, ইহা অনেকবার অনেক প্রকারে দেখা গিয়াছে যে, প্রতিষ্ঠিত শাসন-দণ্ডের উচ্ছেদ করিয়া তাহা অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ শাসন-দণ্ড প্রবর্তিত করিলেও কোন ফল হয় না, বরঞ্চ কুফলই ফলে।

আমাদের ব্রাহ্ম-সমাজের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিলে এই কথাটা অনেকটা বোঝা যায়। সেই সময়ের বাংলা দেশের সহস্র প্রকার অসঙ্গত, অমূলক ও অবোধ্য দেশাচারে বিরক্ত হইয়া কয়েকজন মহৎপ্রাণ মহাত্মা এই অন্যায়রাশির আমূল সংস্কারের তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তিত করিয়া নিজেদের এরূপ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন যে, তাহা নিজেদের যদি বা কাজে লাগিয়া থাকে, দেশের কোন কাজেই লাগিল না। দেশ তাঁহাদের বিদ্রোহী ম্লেচ্ছ খ্রীস্টান মনে করিতে লাগিল। তাঁহারা জাতিভেদ তুলিয়া দিলেন, আহারের আচার-বিচার মানিলেন না, সপ্তাহ অন্তে একদিন গির্জার মত সমাজগৃহে বা মন্দিরের মধ্যে জুতা-মোজা পায়ে দিয়া ভিড় করিয়া উপাসনা করিতে লাগিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারা এত বেশী সংস্কার করিয়া ফেলিলেন যে, তাঁহাদের সমস্ত কার্যকলাপই তৎকাল-প্রতিষ্ঠিত আচার-বিচারের সহিত একেবারে উলটা বলিয়া লোকের চক্ষে পড়িতে লাগিল। ইহা যে হিন্দুর পরম সম্পদ বেদমূলক ধর্ম, সে কথা কেহই বুঝিতে চাহিল না। আজও পাড়াগাঁয়ের লোক ব্রাহ্মদের খ্রীস্টান বলিয়াই মনে করে।

কিন্তু যে-সকল সংস্কার তাঁহারা প্রবর্তিত করিয়া গিয়াছিলেন, দেশের লোক যদি তাহা নিজেদেরই দেশের জিনিস বলিয়া বুঝিতে পারিত এবং গ্রহণ করিত, তাহা হইলে আজ বাঙালী সমাজের এ দুর্দশা বোধ করি থাকিত না। অসীম দুঃখময় এই বিবাহ-সমস্যা, বিধবার সমস্যা, উন্নতিমূলক বিলাত-যাওয়া-সমস্যা, সমস্তই একসঙ্গে একটা নির্দিষ্ট কূলে আসিয়া পৌঁছিতে পারিত। অন্যপক্ষে গতি এবং বৃদ্ধিই যদি সজীবতার লক্ষণ হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে, এই ব্রাহ্ম-সমাজও আজ মৃত্যুমুখে পতিত না হইলেও অকাল-বার্ধক্যে উপনীত হইয়াছে।