এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা  :  সমাজ-ধর্মের মূল্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 19
কিন্তু, এই আইনগুলি কি নির্ভুল? কেহই ত এমন কথা কহে না। ইহার মধ্যে কত অসম্পূর্ণতা, কত অন্যায়, কত অসঙ্গতি ও কঠোরতার শৃঙ্খল রহিয়াছে। নাই কোথায়? রাজার আইনের মধ্যেও আছে, সমাজের আইনের মধ্যেও রহিয়াছে।

এত থাকা সত্ত্বেও, আইন-সম্বন্ধে আলোচনা ও বিচার করিয়া যত লোক যত কথা বলিয়া গিয়াছেন—যদিচ আমি তাঁহাদের মতামত তুলিয়া এই প্রবন্ধের কলেবর ভারাক্রান্ত করিতে চাহি না—মোটের উপর তাঁহারা প্রত্যেকেই স্বীকার করিয়াছেন, আইন যতক্ষণ আইন,—তা ভুলভ্রান্তি তাহাতে যতই কেন থাকুক না, ততক্ষণ—শিরোধার্য তাহাকে করিতেই হইবে। না করার নাম বিদ্রোহ। এবং ''The righteousness of a cause is never alone a sufficient justification of rebellion.”

সামাজিক আইন-কানুন সম্বন্ধেও ঠিক এই কথাই খাটে না কি?

আমি আমাদের সমাজের কথাই বলি। রাজার আইন রাজা দেখিবেন, সে আমার বক্তব্য নয়। কিন্তু সামাজিক আইন-কানুনে-ভুলচুক অন্যায়-অসঙ্গতি কি আছে না-আছে, সে না হয় পরে দেখা যাইবে;—কিন্তু এই সকল থাকা সত্ত্বেও ত ইহাকে মানিয়া চলিতে হইবে। যতক্ষণ ইহা সামাজিক শাসন-বিধি, ততক্ষণ ত শুধু নিজের ন্যায্য দাবীর অছিলায় ইহাকে অতিক্রম করিয়া তুমুল কাণ্ড করিয়া তোলা যায় না। সমাজের অন্যায়, অসঙ্গতি, ভুলভ্রান্তি বিচার করিয়া সংশোধন করা যায়, কিন্তু তাহা না করিয়া শুধু নিজের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের বলে একা একা বা দুই চারিজন সঙ্গী লইয়া বিপ্লব বাধাইয়া দিয়া যে সমাজ-সংস্কারের সুফল পাওয়া যায়, তাহা ত কোনমতেই বলা যায় না।

শ্রীযুক্ত রবিবাবুর 'গোরা' বইখানি যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন, এই প্রকারের কিছু কিছু আলোচনা তাহাতে আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহার কি মীমাংসা করা হইয়াছে, আমি জানি না। তবে, ন্যায়-পক্ষ হইলে এবং উদ্দেশ্য সাধু হইলে যেন দোষ নেই এই রকম মনে হয়। সত্যপ্রিয় পরেশবাবু সত্যকেই একমাত্র লক্ষ্য করিয়া বিপ্লবের সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হন নাই। ''সত্য'' কথাটি শুনিতে মন্দ নয়, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাহার ঠিক চেহারাটি চিনিয়া বাহির করা কঠিন। কারণ, কোন পক্ষই মনে করে না যে, সে অসত্যের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছে। উভয় পক্ষেরই ধারণা—সত্য তাহারই দিকে।

ইহাতে আরও একটি কথা বলা হইয়াছে যে, সমাজ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর হাত দিতে পারে না। কারণ, ব্যক্তির স্বাধীনতা সমাজের জন্য সঙ্কুচিত হইতে পারে না। বরঞ্চ, সমাজকেই এই স্বাধীনতার স্থান যোগাইবার জন্য নিজেকে প্রসারিত করিতে হইবে। পণ্ডিত H. Spencer-এর মতও তাই। তবে, তিনি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এই বলিয়া সীমাবদ্ধ করিয়াছেন যে, যতক্ষণ না তাহা অপরের তুল্য স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু, ভাল করিয়া দেখিতে গেলে, এই অপরের তুল্য স্বাধীনতায় যে কার্যক্ষেত্রে কতদিকে কতপ্রকারে টান ধরে, পরিশেষে ঐ 'সত্য' কথাটির মত কোথায় যে 'সত্য' আছে—তাহার কোন উদ্দেশই পাওয়া যায় না।