এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

অজ্ঞাত রচনা  :  'শ্রীকান্ত'র পরিত্যক্ত অংশ         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 4
এই হতভাগ্যদিগকে আমরা অতিশয় কৃপার চক্ষে দেখি, এবং যে ব্যক্তি আফিং ভোজন করে না, তাহার বাঁচিয়া থাকাটাকে নিছক বিড়ম্বনা বলিয়া মনে করি। যাক ইহাদের কথা। অকস্মাৎ সজাগ হইয়া দেখিলাম, হাতের ‘ভারতবর্ষ’ বুকের উপর আড় হইয়া পড়িয়া আছে, এবং বুকের ভিতরে তাহারই উত্তর হইতে দক্ষিণ এবং পূর্ব হইতে পশ্চিম, সমগ্র ভূখণ্ডটাই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। না হইবেই বা কেন? হেন স্থান ত এই সীমাটুকুর মধ্যে নাই, যেখানে বাল্য ও যৌবনে এই চরণ-জোড়াটি মাড়াইয়া বেড়ায় নাই।

সেটা ছেলেবেলার কথা; অর্থাৎ যখন এমন সুসিদ্ধ, সুপক্ক হইয়া উঠিতে পারি নাই—শুধু চেষ্টা করিতেছি মাত্র। সেই তরুণ-দিনে একজামিন ফেল করার দরুন একবার, এবং লুকাইয়া গাঁজা খাওয়ার তুচ্ছ অপরাধে কানমলা খাইয়া আর একবার, এই মায়ামোহময় অনিত্য সংসার ত্যাগ করিয়া বাবাজী হইয়া গিয়াছিলাম। তারপরে পাহাড় জঙ্গল—সে অনেক কথা—কিন্তু, সে-সব এখন থাক। আবার বাহিরেও অনেকদূর পর্যন্ত গতিবিধি ছিল। অভ্যাসের দোষে আজ সমুদ্রটাকেও ডোবার মত দেখি। কিন্তু, এ-সব কথাতেও এখন কাজ নাই। ছেলেবেলার এই যে ছোট্ট একটু ভ্রমণ-কাহিনী বলিতে বসিয়াছি, ইহা ছাপা হয় ত, সে-সকল ইতিহাস পরেও একদিন হইতে পারিবে।

ছেলেবেলা হইতে ‘ভবঘুরে’ হইয়াই ত বুড়া হইলাম। আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের মুখেই শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ ‘ছি-ছি’ র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়াছিল, বহু কালান্তরে বসিয়া প্রয়োজনবোধে আজ সেই - সব স্মৃত ও বিস্মৃত কাহিনীর মালা গাঁথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে, এই ‘ছি-ছি’টা যত বড় করিয়া সবাই দেখিয়াছে, হয়ত ঠিক তত বড়ই ছিল না। মনে হইতেছে, হয়ত ভগবান যাহাকে তাঁহার বিচিত্র সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেন, তাহাকে ভাল ছেলে হইয়া একজামিন পাস করিবার সুবিধাও দেন না; গাড়ি-পালকি চড়িয়া বহু লোক-লশকর সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিয়া তাহাকে ‘কাহিনী’ নাম দিয়া ছাপাইবার অভিরুচিও দেন না। বুদ্ধি হয়ত ভগবান তাহাদের কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না। তাই প্রবৃত্তি তাহাদের এমনি অসঙ্গত খাপছাড়া এবং দেখিবার বস্তু ও তৃষ্ণাটা স্বভাবতঃই এতই বেয়াড়া হইয়া উঠে যে, তাহার বর্ণনা করিতে গেলে সুধী ব্যক্তিরা বোধ করি হাসিয়াই খুন হইবেন। তারপরে সেই মন্দ ছেলেটি যে কেমন করিয়া অনাদরে অবহেলায় মন্দের আকর্ষণে মন্দ হইয়া, ধাক্কা খাইয়া, অজ্ঞাতসারে অবশেষে একদিন অপযশের ঝুলি কাঁধে ফেলিয়া কোথায় সরিয়া পড়ে—সুদীর্ঘদিন আর তাহার কোন উদ্দেশই পাওয়া যায় না।

কিন্তু এ কি করিতেছি! কাঁদুনি গাহিতে বসিয়া গেলাম কিরূপে? ‘ভ্রমণ-কাহিনী’ যদি বা কেহ শোনে—এ-সকল শুনিবেই বা কে, আর ইহার সমাপ্তি হইবেই বা কোথায়?