এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

অজ্ঞাত রচনা  :  মাতৃভাষা এবং সাহিত্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 6
কিন্তু চিন্তা-পদ্ধতির সর্বাপেক্ষা সাধারণ নিয়ম এই যে, পুরাতন ভাব ও ধারণার ভিত্তি অবলম্বন না করিয়া প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত চিন্তাস্রোতে গা ভাসান না দিয়া মানব-চিত্ত কোনমতেই নতুন ধারণা বা নূতন ভাব আয়ত্ত করিতে পারে না। জ্ঞাত ও সুনির্দিষ্ট পদার্থ নিয়ে অতীত দিনে যেভাবে চিত্তকে নাড়া দিয়া তাহার গুণ ও ধর্মের কাহিনী জানাইয়া দিয়া গিয়াছে, অর্থাৎ তাহার সম্বন্ধে মনের মধ্যে যে জ্ঞান জন্মিয়া রহিয়াছে, সেই জ্ঞানের সহিত তুলনা না করিয়া, তাহাদিগকে ব্যবহার না করিয়া কোনমতেই মানুষ পদার্থের নূতন লক্ষণ ও ধর্মের পরিচয় পাইতে পারে না।

যেমন করিয়া এবং যে-যে উপায়ে শিশুচিত্তে প্রথম চৈতন্যের বিকাশ ঘটিয়াছিল জানিয়া এবং না জানিয়া যে-সকল পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া সেই তরুণ চিত্ত, ভাব, চিন্তা ও ধারণায় অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, যে-সমস্ত জল, হাওয়া ও আলোক পাইয়া তাহার জ্ঞানের অঙ্কুর পল্লবিত হইয়া আজ শাখা-প্রশাখায় বড় হইয়াছে, সে জল, হাওয়া, আলোককে বাদ দিয়া আর একটা অভিনব প্রণালীতে মানবচিত্ত কোনমতেই নূতন জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। অর্থাৎ যেমন করিয়া সে মাতৃক্রোড়ে বসিয়া চিন্তা করিতে শিখিয়াছিল মরিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে সে-পথ ছাড়িয়া যাইতে পারে না—পুরাতন জ্ঞানকে অস্বীকার করিয়া পুরাতন পদ্ধতি ত্যাগ করিয়া কাহারোই নূতন জ্ঞান, নূতন চিন্তা জন্মে না।

আরো একটা কথা। ভাব ও চিন্তা যেমন ভাষার জন্মদান করে, ভাষাও তেমনি চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত, সুসম্বন্ধ ও শৃঙ্খলিত করে। ভাষা ভিন্ন ভাবা যায় না। একটুখানি অনুধাবন করিলেই দেখিতে পাওয়া যায়, যে-কোন একটা ভাষা মনে মনে আবৃত্তি করিয়াই চিন্তা করে—যেখানে ভাষা নাই, সেখানে চিন্তাও নাই।

আবার এইমাত্র বলিয়াছি, পুরাতন নিয়মকে উপেক্ষা করিয়া, পুরাতনের উপর পা না ফেলিয়া নূতনে যাওয়া যায় না—আবার ভাষা ছাড়া সুসম্বন্ধ চিন্তাও হয় না—তাহা হইলে এই দাঁড়ায় বাঙ্গালী বাংলা ছাড়া চিন্তা করিতে পারে না, ইংরাজ ইংরাজি ছাড়া ভাবিতে পারে না। তাহার পক্ষে মাতৃভাষা ভিন্ন যথার্থ চিন্তা যেমন অসম্ভব, বাঙ্গালীর পক্ষেও তেমনি। তা তিনি যত বড় ইংরাজি-জানা মানুষই হউন। বাংলা ভাষা ছাড়া স্বাধীন, মৌলিক বড় চিন্তা কোনমতেই সম্ভব হইবে না।

এ-সব বিজ্ঞানের প্রমাণিত তথ্য। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। চলে শুধু গায়ের জোরে, আর কিছুতে না।

যে ভাষায় প্রথম মা বলিতে শিখিয়াছি, যে ভাষা দিয়া প্রথম এটা ওটা সেটা চিনিয়াছি, যে ভাষায় প্রথমে ‘কেন’ প্রশ্ন করিতে শিখিয়াছি, সেই ভাষার সাহায্য ভিন্ন ভাবুক, চিন্তাশীল কর্মী হইবার আশা করা আর পাগলামি করা এক। তাই যে কথা পূর্বে বলিয়াছি তাহারি পুনরাবৃত্তি করিয়া বলিতেছি, পরভাষায় যত বড় দখলই থাক, তাহাতে ঐ চলা-বলা-খাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা, টাকা রোজগার পর্যন্তই হয়, এর বেশি হয় না, হইতে পারে না।