দুই
সংসারে যাহার যথার্থ মর্মটি উদঘাটন করা যত দুরূহ, মিথ্যায় বিড়ম্বিত করিয়া তোলা তাহাকে তত সহজসাধ্য।
সুবিস্তীর্ণ বারিধির কূল-কিনারা মানুষের চোখের উপর থাকিতে পায় না বলিয়াই উপরের মেঘ ও আকাশ এমন করিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহাকে সব দিকে মিথ্যায় সীমাবদ্ধ করিয়া ফেলিবার সুযোগ পায়।
ভগবান ব্যাপারটির প্রতি চাহিয়া দেখ। ইহার সত্য তত্ত্বটি আবিষ্কার করা নাকি একান্ত কঠিন, তাই কুতত্ত্বে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলা এত সহজ। অজ্ঞানী-জ্ঞানী, বোকা-বুদ্ধিমান সকলেরই যেন বলিবার বিষয় ইহাতে কিছু-না-কিছু থাকেই। আবার সবচেয়ে কৌতুক এই যে, ইহাতে জ্ঞানীর চেয়ে অজ্ঞানীর, বুদ্ধিমানের চেয়ে বোকার হাতটাই বেশি খেলে। ইহাদের নৈপুণ্যই যেন সকলের উপর ফেনাইয়া উঠিতে থাকে। কিন্তু, তাই বলিয়া অকৌতুকও বড় কম নাই। কারণ, ফেনা জিনিসটি চিরস্থায়ী হইয়া রহে না। সুতরাং আনাড়ীর সুবিধাটা শুধুই ততক্ষণ, যতক্ষণ এই ফেনাটা বাঁচিয়া থাকে; যতক্ষণ ভাসমান বুদ্বুদপুঞ্জে আসল বস্তুটি আবৃত করিয়া রাখার উপায় থাকে। এই বুদ্বুদ সমষ্টি কোন গতিকে মরিয়া গেলে আর রক্ষা নাই। তখন অসত্যের যে চেহারা বাহির হইয়া পড়ে তাহা অতি কদর্য, অতি ভয়ানক। এ ছাড়াও একটা নিদারুণ অসুবিধা এই যে, এই সকল অগাধ, অতি বৃহৎ ব্যাপারের সাঁচ্চা ও ঝুটার হিসাব ঠিক এই অনুপাতেই গণনা করা হয়। সুতরাং সে অঙ্কফলে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকেই। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। রাঙ কিনিতে গিয়া ঠকিয়া সীসা কিনিয়া আনিলে ক্ষতি হয়ত হয়, কিন্তু ভরাডুবি হয় না, কিন্তু হীরা কিনিতে গিয়া ঠকিয়া আসিলে যে বস্তুটা ঘরে আসে সেটা কাঁচ মাত্র। একেবারে ফেলিয়া দিতে হয়। সাহিত্যও ঠিক তাই। অপরিসীম ব্যাপার, অগাধ ব্যাপ্তি। সুতরাং ইহারও সাঁচ্চায়-ঝুটায় আকাশ পাতাল প্রভেদ। অথচ, উপরোক্ত কারণে কাহাকেই হাত খেলাইতে নিষেধ করিবার জো নাই। মানুষ যাই আপনাকে বুঝিয়া ফেলে সে অতি-বুদ্ধিমান, যেহেতু, সাংসারিক ছোট বিষয়ে, অর্থাৎ যাহার উভয় তট মানব-চক্ষুর অন্তর্গত, যাহা সুনির্দিষ্ট, যাহাতে হাত দিবামাত্রই পৃথিবীর নির্বোধ লোকগুলোর সহিত অনধিকারচর্চা বাবদে খ্যাচাখিচি বাধে, বেরসিক লোকগুলা তাহাদের অকেজো জগতের বৃহত্তম তোরণের বহির্দেশে অসম্ভ্রমে বিদায় করিয়া দেয়, অমনি বাহিরে আসিয়াই বুদ্ধিমান টের পায় এ জীবনের লক্ষ্য কি! লক্ষ্য সাহিত্য সৃষ্টি করা। শুদ্ধমাত্র এই জন্যই তাঁহার ধরাধামে আগমন। অতএব, আর কালবিলম্ব না করিয়া, অমূল্য সময় অপব্যয় না করিয়া এক পা ছোটগল্প ও আর এক পা খণ্ডকবিতার মাথায় গিয়া হৈহৈ শব্দে কর্তব্যপথে আগুয়ান হইয়া পড়ে।