এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

প্রবন্ধ  :  স্বদেশ ও সাহিত্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 68
কিন্তু এমন কাণ্ড কোথাও কখনো হয় না। আসল কথা এরা বিশ্বাস করতেই পারে না, স্বরাজ নাকি আবার কখনও হতে পারে। তার জন্য আবার নাকি চেষ্টা করা যেতে পারে। কি হবে তাতে, কি হবে চরকায়, কি হবে দেশাত্মবোধের চর্চায়? নিবানো দীপ-শিখার মত মনুষ্যত্ব ধুয়ে মুছে গেছে, একমাত্র হাত পেতে ভিক্ষের চেষ্টা ছাড়া কি হবে আর কিছুতে!

একটা নমুনা দিই :

সেদিন নারী কর্মমন্দির থেকে জন-দুই মহিলা ও শ্রীযুক্ত ডাক্তার প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়কে নিয়ে দুর্যোগের মধ্যেই আমতা অঞ্চলে বেরিয়ে পড়েছিলাম, ভাবলাম ঋষিতুল্য ও সর্বদেশপূজ্য ব্যক্তিটিকে সঙ্গে নেওয়ায় এ যাত্রা আমার সুযাত্রা হবে। হয়েও ছিল। বন্দেমাতরম্‌ ও মহাত্মার ও তাঁর নিজের প্রবল জয়ধ্বনির কোন অভাব ঘটেনি এবং ওই রোগা মানুষটিকে স্থানীয় রায়বাহাদুরের ভাঙ্গা তাঞ্জামের মধ্যে সবলে প্রবেশ করানোরও আন্তরিক ও একান্ত উদ্যম হয়েছিল। কিন্তু তার পরের ইতিহাস সংক্ষেপে এইরূপ—আমাদের যাতায়াতের ব্যয় হল টাকা পঞ্চাশ। ঝড়ে, জলে আমাদের তত্ত্বাবধান করে বেড়াতে পুলিশেরও খরচা হয়ে গেল বোধ হয় এমনি একটা কিছু। বর্ধিষ্ণু স্থান, উকীল মোক্তার ও বহু ধনশালী ব্যক্তির বাস, অতএব স্থানীয় তাঁত ও চরকার উন্নতিকল্পে চাঁদা প্রতিশ্রুত হল তিন টাকা পাঁচ আনা। তারপর আচার্যদেব বহু পরিশ্রমে আবিষ্কার করলেন জন-দুই উকীল বিলাতী কাপড় কেনেন না, এবং একজন তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা করলেন, ভবিষ্যতে তিনি আর কিনবেন না। ফেরবার পথে প্রফুল্লচন্দ্র প্রফুল্ল হয়ে আমার কানে কানে বললেন, হাঁ, জেলাটা উন্নতিশীল বটে! আর একটু লেগে থাকুন, Civil Disobedience বোধ হয় আপনারাই declare করতে পারবেন।

আর জনসাধারণ? সে তো সর্বথা ভদ্রলোকেরই অনুগমন করে।

এ চিত্র দুঃখের চিত্র, বেদনার ইতিহাস, অন্ধকারের ছবি; কিন্তু এই কি শেষ কথা? এই অবস্থাই কি এ জেলার লোক নীরবে শিরোধার্য করে নেবে? কারও কোন কথা, কোন ত্যাগ, কোন কর্তব্যই কি দেখা দেবে না? যারা দেশের সেবাব্রতে জীবন উৎসর্গ করেছে, যারা কোন প্রতিকূল অবস্থাকেই স্বীকার করতে চায় না, যারা Government-এর কাছেও পরাভব স্বীকার করেনি, তারা কি শেষে দেশের লোকের কাছেই হার মেনে ফিরে যাবে? আপনারা কি কোন সংবাদই নেবেন না?

এই প্রসঙ্গে আমার বাঙ্গলা দেশের Provincial Congress Committee-র কথা উল্লেখ করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আর লজ্জা বাড়িয়ে তুলতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।

আমার এক আশা, সংসারের সমস্ত শক্তিই তরঙ্গ গতিতে অগ্রসর হয়। তাই তার উত্থান পতন আছে, চলার বেগে যে আজ নীচে পড়েছে, কাল সেই আবার উপরে উঠবে, নইলে চলা তার সম্পূর্ণ হবে না। পাহাড় গতিহীন, নিশ্চল, তাই তার শিখরদেশ একস্থানে উঁচু হয়েই থাকে, তাকে নামতে হয় না। কিন্তু বায়ু-তাড়িত সমুদ্রের সে ব্যবস্থা নয়—তার উঠা-পড়া আছে; সে তার লজ্জার হেতু নয়, সেই তার গতির চিহ্ন, তার শক্তির ধারা। তখনি সে কেবল উঁচু হয়ে থাকতে চায় যখন জমে বরফ হয়ে উঠে। তেমনি আমাদের এও যদি একটা movement, পরাধীন দেশের একটা অভিনব গতিবেগ, তা হলে উঠা-নামার আইন একেও মেনে নিতে হবে, নইলে চলতেই পারবে না।