এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

প্রবন্ধ  :  স্বদেশ ও সাহিত্য         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 68
আত্মবঞ্চনা অনেক করা গেছে, আর তাতে উদ্যম নেই। জড়ের মত নিশ্চল হয়ে জন্মগত অধিকারের দাবী জানাতেও আর যেমন আমার স্বর ফোটে না, পরের মুখেও তত্ত্বকথা শোনবার ধৈর্য আর আমার নেই। আমি নিশ্চয় জানি, স্বাধীনতার জন্মগত অধিকার যদি কারও থাকে, তা সে মনুষ্যত্বের, মানুষের নয়। অন্ধকারের মাঝে আলোকের জন্মগত অধিকার আছে দীপ-শিখার, দীপের নয়; নিবানো প্রদীপের এই দাবী তুলে হাঙ্গামা করতে যাওয়া শুধু অনর্থক নয়, অপরাধ,—সকল দাবী-দাওয়া উত্থাপনের আগে এ কথা ভুলে গেলে কেবল ইংরাজ নয়, পৃথিবীসুদ্ধ লোক আমোদ অনুভব করবে।

মহাত্মাজী আজ কারাগারে। তাঁর কারাবাসের প্রথম দিনে মারামারি কাটাকাটি বেধে গেল না, সমস্ত ভারতবর্ষ স্তব্ধ হয়ে রইল। দেশের লোকে সগর্বে বললে, এ শুধু মহাত্মাজীর শিক্ষার ফল। Anglo-Indian কাগজওয়ালারা হেসে জবাব দিলে, এ শুধু নিছক Indifference। আমার কিন্তু এ বিবাদে কোন পক্ষকেই প্রতিবাদ করতে মন সরে না। মনে হয়, যদি হয়েও থাকে ত দেশের লোকের এতে গর্বের বস্তু কি আছে? Organised violence করবার আমাদের শক্তি নেই, প্রবৃত্তি নেই, সুযোগ নেই। আর হঠাৎ violence? সে ত কেবল একটা আকস্মিকতার ফল। এই যে আমরা এতগুলি ভদ্রব্যক্তি একত্র হয়েছি, উপদ্রব করা আমাদের কারও ব্যবসা নয়, ইচ্ছাও নয়, অথচ এ কথাও ত কেউ জোর করে বলতে পারেনি আমাদের বাড়ি ফেরবার পথটুকুর মাঝেই, হঠাৎ কিছু-একটা বাধিয়ে না দিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে একটা মস্ত ফ্যাসাদ বেধে যাওয়াও ত অসম্ভব নয়। বাধেনি সে ভালই, এবং আমিও একেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চাইনে, কিন্তু এ নিয়ে দাপাদাপি করে বেড়ানোরও হেতু নাই। একেই মস্ত কৃতিত্ব বলে সান্ত্বনা লাভ করতে যাওয়া আত্মপ্রবঞ্চনা। আর Indifference? এ কথায় যদি কেউ এই ইঙ্গিত করে থাকে যে, মহাত্মার কারারোধে দেশের লোকের গভীর ব্যথা বাজেনি, ত তার বড় মিছে কথা আর হতেই পারে না। ব্যথা আমাদের মর্মান্তিক হয়েই বেজেছে; কিন্তু তাকে নিঃশব্দে সহ্য করাই আমাদের স্বভাব, প্রতিকারের কল্পনা আমাদের মনেই আসে না।

প্রিয়তম পরমাত্মীয় কাউকে যমে নিলে শোকার্ত মন যেমন উপায়হীন বেদনায় কাঁদতে থাকে, অথচ, যা অবশ্যম্ভাবী তার বিরুদ্ধে হাত নেই, এই বলে মনকে বুঝিয়ে আবার খাওয়া-পরা, আমোদ-আহ্লাদ, হাসি-তামাশা, কাজ-কর্ম যথারীতি পূর্বের মতই চলতে থাকে, মহাত্মার সম্বন্ধেও দেশের লোকের মনোভাব প্রায় তেমনি। তাদের রাগ গিয়ে পড়ল জজসাহেবের উপর। কেউ বললে তার প্রশংসাবাক্য কেবল ভণ্ডামি, কেউ বললে তার দু’বছর জেল দেওয়া উচিত ছিল, কেউ বললে বড় জোর তিন বছর, কেউ বললে না চার বছর, কিন্তু ছ’বছর জেল যখন হল তখন আর উপায় কি? এখন গবর্নমেন্ট যদি দয়া করে কিছু আগে ছাড়েন তবেই হয়। কিন্তু এই ভেবে তিনি জেলে যাননি। তাঁর একান্ত মনের আশা ছিল হোক না জেল ছ’বছর, হোক না জেল দশ বছর,—তাঁকে মুক্ত করা ত দেশের লোকেরই হাতে। যে দিন তারা চাইবে, তার একটা দিন বেশি কেউ তাকে জেলে ধরে রাখতে পারবে না, তা সে গবর্নমেন্ট যতই কেন না শক্তিশালী হউন। কিন্তু সে আশা তাঁর একলারই ছিল, দেশের লোকের সে ভরসা করবার সাহস হলো না।