বিজয়া। তা বটে, কিন্তু মনে হয় বাবার ঠিক এই ইচ্ছা ছিল না। জগদীশবাবুকে তিনি চিরদিন মনে মনে ভালবাসতেন।
বিলাস। এমন হতেই পারে না। সেই দুষ্ক্রিয়াসক্ত মাতালটাকে তিনি ভালবাসতেন এ বিশ্বাস আমি করতে পারি না।
বিজয়া। বাবার সঙ্গে এ নিয়ে আমিও তর্ক করেছি। তাঁর কাছেই শুনেছি, তিনি, আপনার বাবা ও জগদীশবাবু এই তিনজনে—শুধু সতীর্থ নয়, পরস্পরের পরম বন্ধু ছিলেন। জগদীশবাবুই ছিলেন সবার চেয়ে মেধাবী ছাত্র, কিন্তু যেমন দুর্বল, তেমনি দরিদ্র। বড় হয়ে বাবা ও আপনার বাবা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন, কিন্তু জগদীশবাবু পারলেন না। গ্রামের মধ্যে নির্যাতন শুরু হল। আপনার বাবা অত্যাচার সয়ে গ্রামেই রইলেন, কিন্তু বাবা পারলেন না, সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার আপনার বাবার উপর দিয়ে, মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন, আর জগদীশবাবু স্ত্রী নিয়ে ওকালতি করতে পশ্চিমে চলে গেলেন।
বিলাস। এ-সব আমিও জানি।
বিজয়া। জানবার কথাই ত। পশ্চিমে তিনি বড় উকিল হয়েছিলেন। কোন দোষই ছিল না, শুধু স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তাঁর দুর্গতি শুরু হ’ল।
বিলাস। অমার্জনীয় অপরাধ।
বিজয়া। তা বটে, কিন্তু এর অনেক পরে আমার নিজের মা মারা গেলে বাবা একদিন কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিলেন, কেন যে জগদীশ মদ ধরেছিল সে যেন বুঝতে পারি বিজয়া।
বিলাস। বলেন কি? তাঁর মুখে মদ খাবার justification?
বিজয়া। আপনি কি যে বলেন বিলাসবাবু! justification নয়—বাল্যবন্ধুর ব্যথার পরিমাণটাই বাবা ইঙ্গিত করেছিলেন। সম্ভ্রম গেল, স্বাস্থ্য গেল, উপার্জন গেল, সমস্ত নষ্ট করে তিনি দেশে ফিরে এলেন।
বিলাস। বড় কীর্তিই করেছিলেন!
বিজয়া। সব গেল, শুধু গেল না বোধ হয় আমার বাবার বন্ধু-স্নেহ। তাই যখনই জগদীশবাবু টাকা চেয়েছেন তিনি না বলতে পারেন নি।
বিলাস। তা হলে ঋণ না দিয়ে দান করলেই ত পারতেন।
বিজয়া। তা জানিনে বিলাসবাবু। হয়ত দান করে বন্ধুর শেষ আত্মসম্মানবোধটুকু বাবা নিঃশেষ করতে চাননি।
বিলাস। দেখুন, এ-সব আপনার কবিরে কথা, নইলে ঋণ ছেড়ে দেবার উপদেশ তিনি আপনাকেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিসের জন্য তা করেন নি?
বিজয়া। তা জানিনে। কোন আদেশ দিয়েই তিনি আমাকে আবদ্ধ করে যাননি। বরঞ্চ, কথা উঠলে বাবা এই কথা বলতেন, মা, তোমার ধর্মবুদ্ধি দিয়েই তোমার কর্তব্য নিরূপণ করো। আমার ইচ্ছের শাসনে তোমাকে আমি বেঁধে রেখে যাব না। কিন্তু পিতৃঋণের দায়ে পুত্রকে গৃহহীন করার সঙ্কল্প বোধ হয় তাঁর ছিল না। তাঁর ছেলের নাম শুনেছি নরেন্দ্র! তিনি কোথায় আছেন জানেন?
বিলাস। জানি। মাতাল বাপের শ্রাদ্ধ শেষ করে সে নাকি বাড়িতেই আছে। পিতৃঋণ যে শোধ করে না সে কুপুত্র। তাকে দয়া করা অপরাধ।
বিজয়া। আপনার সঙ্গে বোধ হয় তাঁর আলাপ আছে?
বিলাস। আলাপ! ছিঃ—আপনি আমায় কি মনে করেন বলুন ত? আমি ত ভাবতেই পারিনে যে, জগদীশ মুখুয্যের ছেলের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি| তবে সেদিন রাস্তায় হঠাৎ পাগলের মত একটা নতুন লোক দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম—শুনলাম সেই-ই নাকি নরেন মুখুয্যে।