হরিচরণ মুখ কালো করিয়া বলিল, হুঁ করবেন বৈ কি।
পরদিন হরিচরণ দড়ি লইয়া ফিতা লইয়া বাড়িময় মাপজোখ করিয়া বেড়াইতে লাগিল, গুরুচরণ জিজ্ঞাসাও করিলেন না, বাধাও দিলেন না। দিন দুই-তিন পরে ইঁট কাঠ বালি চুন আসিয়া পড়িল; বাড়ির পুরানো ঝি আসিয়া খবর দিল, কাল থেকে রাজমিস্ত্রী লাগবে, ছোটবাবুর পাঁচিল পড়বে।
গুরুচরণ সহাস্যে কহিলেন, সে ত দেখতেই পাচ্ছি গো, বলতে হবে কেন!
দিন পাঁচ-ছয় পরে একদিন সন্ধ্যার পরে দ্বারের বাহিরে পদশব্দ শুনিয়া গুরুচরণ মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, পঞ্চুর মা, কি গা?
পঞ্চুর মা বহুদিনের দাসী, সে ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলিল, মেজবৌমা দাঁড়িয়ে আছেন, বড়বাবু।
বড়বৌয়ের মৃত্যুর পর হইতে বিধবা ভ্রাতৃবধূই এ-সংসারের গৃহিণী, তিনি অন্তরাল হইতে ভাশুরের সহিত কথা কহিতেন; মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, শ্বশুরের ভিটেতে কি আমার কোন দাবী নেই যে ছোটবৌয়েরা আমাকে অহরহ গালমন্দ করচে?
গুরুচরণ কহিলেন, আছে বৈ কি বৌমা, যেমন তাঁদের আছে, ঠিক তোমারও তেমনি আছে।
পঞ্চুর মা বলিল, কিন্তু এমন ধারা করলে ত বাড়িতে আর টিকতে পারা যায় না।
গুরুচরণ সমস্ত শুনিতেছিলেন, ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, পরেশকে আসতে চিঠি লিখে দিয়েচি পঞ্চুর মা, একবার সে এসে পড়লেই সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে,—এ ক’টা দিন তোমরা একটু সহ্য করে থাকো।
মেজবৌ ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, কিন্তু পরেশ কি—
গুরুচরণ বাধা দিয়া কহিলেন, কিন্তু নয় মেজবৌমা, আমার পরেশের সম্বন্ধে কিন্তু চলে না। হরি তার বাপ বটে, কিন্তু সে আমারই ছেলে, সমস্ত পৃথিবী যদি একদিকে যায়, তবু সে আমারই। তার জ্যাঠামশায় যে কখনো অন্যায় করে না এ যদি সে না বোঝে ত বৃথাই এতদিন পরের ছেলেকে বুক দিয়ে মানুষ করে এলাম।
দাসী কহিল, সে আর বলতে? সে বছর মায়ের অনুগ্রহ হলে তুমি ছাড়া আর যমের মুখ থেকে তাকে কে কেড়ে আনতে পারতো বড়বাবু? তখন কোথাই বা ছোটবাবু, আর কোথাই বা তার সৎমা। ভয়ে একবার দেখতে পর্যন্ত এলো না। তখন একলা জ্যাঠামশায়, কিবা দিন কিবা রাত্রি।
মেজবৌমা বলিলেন, পরেশের নিজের মা বেঁচে থাকলেও হয়ত এতখানি করতে পারতেন না।