এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

গল্প  :  স্বামী         
পরিচ্ছেদ: / 1
পৃষ্ঠা: / 33
গিয়ে মালীদের চালার মধ্যে ঢুকে পড়লুম। কেউ নেই, খুঁটি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘের পানে চেয়ে ভাবচি, ঝমঝম করে ছুটে এসে কে ঢুকে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখি—ওমা! এ যে নরেনবাবু! কলকাতা থেকে তিনি যে বাড়ি এসেছেন, কৈ, সে ত আমি শুনিনি।

আমাকে দেখে চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ, সদু যে! এখানে?

অনেকদিন তাঁকে দেখিনি, অনেকদিন তাঁর গলা শুনিনি, আমার বুকের মধ্যে যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। কান পর্যন্ত লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠল, মুখের পানে চেয়ে ত জবাব দিতে পারলুম না, মাটির দিকে চেয়ে বললুম, আমি ত রোজই ফুল কুড়ুতে আসি। কবে এলেন?

নরেন মালীদের একটা ভাঙ্গা খাটিয়া টেনে নিয়ে বসে বললে, আজ সকালে। কিন্তু তুমি কার হুকুমে ফুল চুরি কর শুনি?

গম্ভীর গলায় আশ্চর্য হয়ে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, চোখ দুটো তার চাপা হাসিতে নাচচে।

লজ্জা! লজ্জা! এই পোড়ার মুখেও কোথা থেকে হাসি এসে পড়ল, বললুম, তাই বৈ কি! কষ্ট করে কুড়িয়ে নিলে বুঝি চুরি করা হয়?

নরেন ফস্‌ করে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আর আমি যদি ঐ কুড়ান ফুলগুলো তোমার কোঁচড়ের ভেতর থেকে আর একবার কুড়িয়ে নিই, তাকে কি বলে?

জানিনে, কেন আমার ভয় হল, সত্যিই যেন এইবার সে এসে আমার আঁচল চেপে ধরবে। হাতের মুঠা আমার আলগা হয়ে গিয়ে চোখের পলকে সমস্ত ফুল ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল।

ও কি করলে?

আমি কোনমতে আপনাকে সামলে নিয়ে বললুম, আপনাদেরই ত ফুল, বেশ ত, নিন না কুড়িয়ে।

এ্যাঁ! এত অভিমান! বলে সে উঠে এসে আমার আঁচলটা টেনে নিয়ে ফুল কুড়িয়ে কুড়িয়ে রাখতে লাগল। কেন জানিনে, হঠাৎ আমার দু'চোখ জলে ভরে গেল, আমি জোর করে মুখ ফিরিয়ে আর-একদিকে চেয়ে রইলুম।

সমস্ত ফুলগুলি কুড়িয়ে আমার আঁচলে একটা গেরো দিয়ে, নরেন তার জায়গায় ফিরে গেল। খানিকক্ষণ আমার পানে চুপ করে চেয়ে থেকে বললে, যে ঠাট্টা বুঝতে পারে না, এত অল্পে রাগ করে, তার ফিলজফি পড়া কেন? আমি কালই গিয়ে ব্রজবাবুকে বলে দেব, তিনি আর যেন পণ্ডশ্রম না করেন।

আমি আগেই চোখ মুছে ফেলেছিলুম, বললুম, কে রাগ করেছে?

যে ফুল ফেলে দিলে?

ফুল ত আপনি পড়ে গেল।

মুখখানাও বুঝি আপনি ফিরে আছে?

আমি ত মেঘ দেখচি।

মেঘ বুঝি এদিকে ফিরে দেখা যায় না?

কৈ যায়? বলে আমি ভুলে হঠাৎ মুখ ফেরাতেই দু'জনার চোখাচোখি হয়ে গেল। নরেন ফিক করে হেসে বললে, একখানা আরশি থাকলে যায় কি না, দেখিয়ে দিতুম। নিজের মুখে-চোখেই একসঙ্গে মেঘ-বিদ্যুৎ দেখতে পেতে; কষ্ট করে আকাশ খুঁজতে হত না।

আমি তখন চোখ ফিরিয়ে নিলুম। রূপের প্রশংসা আমি ঢের শুনেছি, কিন্তু নরেনের চাপা হাসি, চাপা ইঙ্গিত, সেদিন আমার বুকের মধ্যে ঢুকে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে যেন সজোরে দুলিয়ে দিলে। এই ত সেই পাঁচ বছর আগের কথা, কিন্তু আজ মনে হয়, সে সৌদামিনী বুঝি বা আর কেউ ছিল।