বিন্দুর ছেলে
এক
যাদব মুখুয্যে ও মাধব মুখুয্যে যে সহোদর ছিলেন না, সে কথা নিজেরা ত ভুলিয়াই ছিলেন, বাহিরের লোকও ভুলিয়াছিল। দরিদ্র যাদব অনেক কষ্টে ছোটভাই মাধবকে আইন পাশ করাইয়াছিলেন এবং বহু চেষ্টায় ধনাঢ্য জমিদারের একমাএ সন্তান বিন্দুবাসিনীকে ভ্রাতৃবধূরূপে ঘরে আনিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। বিন্দুবাসিনী অসামান্যা রূপসী। প্রথম যেদিন সে এই অতুল রূপ ও দশ সহস্র টাকার কাগজ লইয়া ঘর করিতে আসিয়াছিল, সেদিন বড়বৌ অন্নপূর্ণার চোখে আনন্দাশ্রু বহিয়াছিল। বাড়িতে শাশুড়ী-ননদ ছিল না, তিনিই ছিলেন গৃহিণী। ছোটবধূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া প্রতিবাসিনীদের কাছে সগর্বে বলিয়াছিলেন, ঘরে বৌ আনতে হয় ত এমনি।
একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা। কিন্তু দু'দিনেই তাঁহার এ ভুল ভাঙ্গিল। দু'দিনেই টের পাইলেন, ছোটবৌ যে ওজনে রূপ ও টাকা আনিয়াছে, তাহার চতুর্গুণ অহঙ্কার-অভিমানও সঙ্গে আনিয়াছে।
একদিন বড়বৌ স্বামীকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, হাঁ গা, রূপ আর টাকার পুঁটুলি দেখে ঘরে বৌ আনলে, কিন্তু এ যে কেউটে সাপ!
যাদব কথাটা বিশ্বাস করিলেন না। মাথা চুলকাইয়া বার-দুই 'তাই ত', 'তাই ত', করিয়া কাছারি চলিয়া গেলেন।
যাদব অতিশয় শান্ত-প্রকৃতির লোক। জমিদারী সেরেস্তায় নায়েবি এবং ঘরে আসিয়া পূজা-অর্চনা করিতেন। মাধব দাদার চেয়ে দশ-বারো বছরের ছোট, উকিল হইয়া সম্প্রতি ব্যবসা শুরু করিয়াছিল।
সে আসিয়া কহিল, বৌঠান, টাকাটাই কি দাদার বেশী হ’ল? দুদিন সবুর করলে আমিও ত রোজগার করে দিতে পারতাম। অন্নপূর্ণা চুপ করিয়া রহিলেন।
এ ছাড়া আরও একটা বিপদ এই হইয়াছিল, ছোটবৌকে শাসন করিবার জো ছিল না। তাহার এমনি ভয়ঙ্কর ফিটের ব্যামো ছিল যে, সেদিকে চাহিয়া দেখিলেও বাড়িসুদ্ধ লোকের মাথা ঝিমঝিম করিতে থাকিত এবং ডাক্তার না ডাকিলে আর উপায় হইত না। সুতরাং সাধের বিবাহটা যে ভুল হইয়া গিয়াছে, এই ধারণাই সকলের মনে বদ্ধমূল হইয়া গেল। শুধু যাদব হাল ছাড়িলেন না। তিনি সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া ক্রমাগত বলিতে লাগিলেন, না গো না, তোমরা পরে দেখো। মায়ের আমার অমন জগদ্ধাত্রীর মত রূপ, সে কি একেবারে নিষ্ফল যাবে? এ হতেই পারে না।