অতএব এ-সকলও থাক। যাহা বলিতে বসিয়াছি, তাহাই বলি। কিন্তু বলিলেই ত বলা হয় না, ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা আর। যাহার পা-দুটো আছে, সে-ই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত-দুটো থাকিলেই ত আর লেখা যায় না। সে যে ভারী শক্ত। তাছাড়া মস্ত মুশকিল হইয়াছে আমার এই যে, ভগবান আমার মধ্যে কল্পনা-কবিত্বের বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পোড়া চোখ দিয়া আমি যা কিছু দেখি, ঠিক তাহাই দেখি। গাছকে ঠিক গাছই দেখি—পাহাড়-পর্বতকে পাহাড়-পর্বতই দেখি। জলের দিকে চাহিয়া, জলকে জল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। আকাশে মেঘের পানে চোখ তুলিয়া রাখিয়া ঘাড়ে ব্যথা করিয়া ফেলিয়াছি, কিন্তু যে মেঘ সেই মেঘ। কাহারো নিবিড় এলোকেশের রাশি চুলোয় যাক—একগাছি চুলের সন্ধানও কোনদিন তাহার মধ্যে খুঁজিয়া পাই নাই। চাঁদের পানে চাহিয়া চোখ ঠিকরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু কাহারো মুখটুকু ত কখনো নজরে পড়ে নাই!
এমন করিয়া ভগবান যখন বিড়ম্বিত করিয়াছেন, তখন আমি আর কি উপায় করিব? তাই পূর্বেই বলিয়াছি—নিরুপায় হইয়া হালটা ত প্রায় ছাড়িয়াই দিয়াছিলাম! হঠাৎ সেদিন বড় একটা ফন্দি মাথায় ঢুকিয়াছে! আচ্ছা, এক কাজ করি না কেন? বড় বড় লোকের ভ্রমণ-কাহিনীগুলো পড়িয়া লই না কেন? অতএব আর দ্বিধা নয়—ইহাই স্থির। তখন হইতে ইহাই উলটিয়া-পালটিয়া অধ্যয়ন করিয়া করিয়া, আজ আমার এমনি সাহস বাড়িয়া গিয়াছে যে সত্য সত্যই লিখিতে বসিয়া গিয়াছি। শুধু তাই নয়, আমার নিশ্চয় মনে হইতেছে, কাহিনী লিখিবার গুপ্ত ‘এলেম’টায় লায়েক হইয়া পড়িয়াছি!
কিন্তু এ কি নিদারুণ ব্যবধান! বড়লোক এবং দুঃখীকে ভগবান কি আলাদা করিয়াই গড়িয়াছেন! উভয়ের বেড়াইয়া-বেড়ানোর মধ্যেও কি আকাশ-পাতাল পার্থক্য!
বড়লোক ক্রমাগত বলিতেছেন—‘আমি! আমি! আমি! ওগো তোমরা দেশের হতভাগা পাঁচজন চোখ চাহিয়া ইহার প্রতি অক্ষরটি পড়, হাঁ করিয়া আমার প্রতি শব্দটি শোন—আমি বিদেশে গিয়াছিলাম।’
কিন্তু সে যেন হইল। তাঁহাদের কাজ না হয় তাঁহারা ভবিষ্যতে ভাল করিয়াই করিলেন।
কিন্তু আমার দুঃখ তাহাতে ত ঘুচিবে না। বড়লোক ত নই। আমার অহংটা কোনদিনই ত তেমন করিয়া হাত-পা ঝাড়া দিয়া বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে নাই। আমি হাজার চেষ্টা করিয়াও অতটা সাহস করিয়া ‘আমি’ ‘আমি’ করিতে পারিব কিনা, সে ভরসা ত কোনমতেই পাঠকবর্গকে দিতে পারিতেছি না।