কথা কইচে, শেখাচ্চে, পড়াচ্চে,—আবার নিজেও কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু একটা ফোঁড় কখনো উলটো পড়ে না! তার হাতের কাজ যদি দেখ মা ত অবাক হয়ে যাবে।
জগদ্ধাত্রী বিশেষ খুশি হইলেন না! নিজের মেয়ের চেয়ে পরের মেয়ের অধিক গুণপনার কথা বোধ করি তাঁহার তেমন ভাল লাগিল না। অবহেলার ভাবে বলিলেন—হবে না কেন বাছা! আমাদের হিঁদুর ঘরের মেয়েরা ত আর মেম রেখে সেলাই শিখতে যায় না! শিখলে ওদের মতই হতো। ছোঁয়াছুঁয়ি করে ওদের নাইতেও হয় না, কাপড়টাও ছাড়তে হয় না। মা গো মা! হাজার হোক বাঙালী ঘরের মেয়ে ত! কি করে যে সেই কাপড়-চোপড়ে ওদের মুখে ভাত ওঠে, আমি তাই শুধু ভাবি। বলিতে বলিতেই তিনি ঘৃণায় যেন কণ্টকিত হইয়া উঠিলেন।
নিরুপমা নীরবে কাজ করিতে লাগিল,—কথা কহিল না।
জগদ্ধাত্রী একটু স্থির থাকিয়া কহিলেন, তোর বাপের সেই হাতকাটা জামাটা একটু ছিঁড়ে গেছে—নিয়ে আসব সেরে দিতে পারবি?
নিরুপমা মুখ না তুলিয়াই বলিল, পারবো বৈ কি মা, নিয়ে এসো।
জগদ্ধাত্রী জামা আনিতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ এই অসময়ে অরুণকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলেন। অরুণের হাতে একখানা কাগজের মোড়ক ছিল। সে মুহূর্তকাল থামিয়া কহিল, খুড়ীমা, ভাল ত সব? বলিতে বলিতেই তাহার দৃষ্টি কর্ম-নিরত নিরুপমার উপরে গিয়া পড়ল।
জগদ্ধাত্রী অপ্রসন্ন স্বরে বলিলেন, ভাল আর তেমন কৈ বাছা! আমার—
কিন্তু কথাটা শেষ হইতে পাইল না কারণ, দাঁড়াইয়া শুনিবার ধৈর্য অরুণের ছিল না। সে সোজা অগ্রসর হইয়া গিয়া নিরুপমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, এই নাও তোমার কার্পেটের প্যাটার্ন। সন্ধ্যা বললে, কলকাতায় যাচ্ছো দাদা, অমনি নিরুপমার জন্যে আমার মত একটা কিনে এনো। তা খুঁজে খুঁজে আর কোথাও পাইনে, শেষে একটা সাহেবের দোকান থেকে জোগাড় করেচি।
নিরুপমা হাত বাড়াইয়া মোড়কটি গ্রহণ করিয়া কৃত্রিম ভর্ৎসনার স্বরে কহিল, কেন তুমি এই রোদের মধ্যে এত কষ্ট করতে গেলে? এ প্যাটার্ন আমার না হয় নাই হতো। ইস্টিশান থকে সোজা আসচ বুঝি? এখনো বাড়ি যাওনি? নাওয়া খাওয়া হয়নি?
না। এক গেলাস জল দাও দিকি। ভয়ানক তেষ্টা পেয়েচে।