বস্তুতঃ এইখানে আঘাত দেওয়ার মত বড় আঘাত বর্তমানকালে আর নেই। নানা অসম্মানে ক্ষিপ্ত হয়ে কংগ্রেস ব্রিটিশ-পণ্য বর্জনের সঙ্কল্প গ্রহণ করেছে; সঙ্কল্প তাদের সিদ্ধ হোক। বাঙ্গালার তরুণের দল, এই সংঘর্ষে তোমরা তাদের সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করো। কিন্তু অন্ধের মত নয়; মহাত্মাজী হুকুম করলেও নয়; কংগ্রেস সমস্বরে তার প্রতিধ্বনি করে বেড়ালেও নয়। ভারতের বিশ লাখ টাকার খাদি দিয়ে আশি ক্রোর টাকার অভাব পূর্ণ করা যায় না। কাঠের চরকা দিয়ে লোহার যন্ত্রকেও হারানো যায় না, এবং গেলেও তাতে মানুষের কল্যাণের পথ সুপ্রশস্ত হয় না। বিশেষতঃ সম্প্রতি এটা অর্থনৈতিক বিবাদ নয়, রাজনৈতিক বিবাদ। এ কথা কোনমতেই ভোলা উচিত নয়। সুতরাং জাপানী সূতায় দেশের তাঁতের কাপড় দিয়ে হোক, দেশের কলকব্জার তৈরী কাপড় দিয়ে অথবা খেয়ালী লোকের খদ্দর দিয়েই হোক, এ ব্রত উদ্যাপন করাই চাই। বাঙ্গালাদেশে এই ব্রত অজানা নয়। সেদিন যে পথ বাঙ্গালার মনীষীরা স্থির করে দিয়েছিলেন, আজও সেই পথেই এই সঙ্কল্প সার্থক হবে। British cloth—এর স্থানে foreign cloth জুড়ে দিয়ে অহিংসা-নীতির পরাকাষ্ঠা দেখানো যেতে পারে, কিন্তু অসম্ভবের মোহে, আত্মবঞ্চনায় শুধু বঞ্চনার জঞ্জালই স্তূপাকার হবে—আর কিছুই হবে না। আগামী ৩১শে ডিসেম্বরের ভোজবাজি সেবারের মতনই চোখে ধুলো দিয়ে নির্বিঘ্নে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে।
বাঙ্গালার পল্লীতে আমার গৃহ; বাঙ্গালাকে আমি চিনিনে এ অপবাদ বোধ করি আমার অতিবড় শত্রুও আমাকে দেবে না। ঘরে ঘরে গিয়ে দেখেছি, এ জিনিস চলে না। স্বদেশবৎসল দুই-চারজন পুরুষের যদি-বা চলে, মেয়েদের চলে না। অন্যান্য প্রদেশের কথা জানিনে, কিন্তু এ দেশের তাদের দিনান্তে অনেকগুলি বস্ত্রের প্রয়োজন। এই এ দেশের সামাজিক রীতি এবং এই এ দেশের মজ্জাগত সংস্কার। সভায় দাঁড়িয়ে খদ্দরের মহিমায় গলা ফাটালেও সে চীৎকার গিয়ে কোনোমতেই পল্লীর নিভৃত অন্তঃপুরে পৌঁছবে না। সচ্ছল গৃহস্থের কথাই শুধু বলিনে, গরীব চাষাভুষোর ঘরের কথাও আমি বলছি,— এই সত্য, এবং একে স্বীকার করাই ভাল। বাঙ্গালার কোনো একটা বিশেষ সবডিভিসনে মণ-দুই চরকায়-কাটা সুতো তৈরী হওয়ার নজীর দাখিল করে এর জবাব দেওয়া যাবে না। এই তো গেল খদ্দরের বিবরণ। চরকারও ঐ অবস্থা। আমাদের ওদিকে চাষাভুষো দরিদ্র ঘরে মেয়েদের উদয়াস্ত খাটুনি। তারই ফাঁকে এক-আধ ঘন্টা যদি সময় পায়, মহাত্মার আদেশ জানিয়ে চরকার হাতল হাতে তার গুঁজে দিলেও ঘুমিয়ে পড়ে। দোষ দিতে পারিনে। বোধ হয় সত্যিকার প্রয়োজন নেই বলেই এমনি ঘটে।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা আবশ্যক মনে করি। এ দেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির মত,—মানুষের জীবনযাত্রার প্রয়োজন নিত্যই কমিয়ে আনা দরকার। অভাব-বোধই দুঃখ।