এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

নাটক  :  ষোড়শী         
পরিচ্ছেদ: / 4
পৃষ্ঠা: / 54
[এককড়ি ও বল্লভের প্রস্থান

জীবানন্দ। চোখ বুজে শুয়ে কত কি মনে হচ্ছিল প্রফুল্ল। মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য এই পৃথিবী। নইলে আমার জন্যে চোখের জল ফেলতে তোমাকে পেয়েছিলাম কি করে?

প্রফুল্ল। আপনি ত জানেন—

জীবানন্দ। জানি বৈ কি প্রফুল্ল! কিন্তু এককড়ি তার কি জানে? সে জানে তারই মত তুমিও শুধু একজন কর্মচারী, এক পাষণ্ড জমিদারের তেমনি অসাধু সঙ্গী। কত যে করেছ, নীরবে কত যে সয়েছ, বাইরের লোকে তার কি খবর রাখে। মাঝে মাঝে যখন অসহ্য হয়েচে দুটো ভাতডাল যোগাড়ের ছল করে ত্যাগ করে যেতে চেয়েছ, কিন্তু যেতে আমি দিইনি। আজ ভাবি ভালোই করেচি। সত্যই ছেড়ে চলে যদি যেতে প্রফুল্ল, আজকের দুঃখ রাখবার জায়গা পেতে কোথায়?

প্রফুল্ল। দাদা—

জীবানন্দ। একটুখানি কাগজ-কলম আনো না প্রফুল্ল, তোমার দাদার স্নেহের দান—

প্রফুল্ল। (পদতলে নতজানু হইয়া বসিয়া) স্নেহ আপনার অনেক পেয়েছি দাদা, সেই শুধু আমার সম্বল হয়ে থাক। আপনি কেবল আমাকে এই আশীর্বাদ করুন, নিজের পরিশ্রমে যা-কিছু পাই এ জীবনে তার বেশি না লোভ করি।

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া) বেশ, তাই হোক প্রফুল্ল। দান করে তোমাকে আমি খাটো করে যাব না। কিন্তু লোভী তুমি ত কোনদিনই নও!

[বল্লভ নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া ঔষধের পাত্র প্রফুল্লের হাতে দিয়া তেমনি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল]

প্রফুল্ল। দাদা! এই ওষুধটুকু খান।

[প্রফুল্ল কাছে আসিয়া ঔষধ জীবানন্দের মুখে ঢালিয়া দিয়া নিজের কোঁচার খুঁট দিয়া তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্ত মুছাইয়া দিল]

জীবানন্দ। কি ভয়ানক অন্ধকার প্রফুল্ল! রাত্রি কত হলো ভাই?

প্রফুল্ল। রাত্রি ত এখনো হয়নি দাদা।

জীবানন্দ। হয়নি? তবে আমার দু'চক্ষে এ নিবিড় আঁধার কিসের প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। অন্ধকার ত নেই দাদা! এখনো যে সূর্যাস্তও হয়নি।

জীবানন্দ। হয়নি? যায়নি সূর্য এখনো ডুবে? তবে খোল, খোল,—আমার সুমুখের জানালা খুলে দাও প্রফুল্ল, একবার দেখি তাঁকে। যাবার আগে আমার শেষ নমস্কার তাঁকে জানিয়ে যাই।

[প্রফুল্ল সম্মুখের বাতায়ন খুলিয়া দিল এবং কাছে আসিয়া জীবানন্দের ইঙ্গিত-মত তাঁহার মাথাটি সযত্নে উঁচু করিয়া দিল। অদূরে বারুইয়ের শীর্ণ জলধারা মন্দবেগে বহিতেছে। পরপারে সূর্য অস্তগমনোম্মুখ। দূরে নীল বনানী আরক্ত আভায় রঞ্জিত। তটে ধূসর বালুকারাশি উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে]

জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া কম্পিত দুই হস্ত যুক্ত করিয়া ললাটে স্পর্শ করাইলেন। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) বিশ্বদেব! কে বলে তুমি অচেনা? তুমি চির-রহস্যে ঢাকা?

জন্মান্তরের সহস্র পরিচয় যে আজ যাবার দিনে তোমার মুখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। (একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ভেবেছিলাম, হয়ত তোমাকে দেখে ভয় হবে—হয়ত এ জীবনের শতেক গ্লানি দীর্ঘ কালো ছায়া মেলে আজ মুখ তোমার ঢেকে দেবে, কিন্তু সে ত হতে দাওনি! বন্ধু, এ-জন্মের শেষ নমস্কার তুমি গ্রহণ কর। (শ্রান্তিতে ঢলিয়া পড়িয়া) উঃ— কি ব্যথা!

প্রফুল্ল। (ব্যাকুল কণ্ঠে) ব্যথা কোথায় দাদা?

জীবানন্দ। কোথায়? মাথায়, বুকে, আমার সর্বাঙ্গে, প্রফুল্ল—উঃ—

[দ্রুতপদে ষোড়শী প্রবেশ করিল। তাহার পশ্চাতে এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তার]

ষোড়শী। এ কি কথা এরা সব বলে প্রফুল্ল! (জীবানন্দের পদতলে বসিয়া পড়িল) তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে যে আজ সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি! কিন্তু নিষ্ঠুর—অভিমানে এ কি করলে তুমি!

প্রফুল্ল। দাদা, চেয়ে দেখুন অলকা এসেছেন।

জীবানন্দ। অলকা? এলে তুমি? (ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) কিন্তু, সময় নেই আর।