এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

গল্প  :  পথ-নির্দেশ         
পরিচ্ছেদ: / 7
পৃষ্ঠা: / 27
হেম একবারমাত্র তাহার মুখপানে চাহিয়া সব ভুলিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া উঠিল। কাল হইতেই তাহার চোখের জল শুকায় নাই, আজ অকস্মাৎ মানদাকে পাইয়া তাহার প্রায় এক বৎসরের রুদ্ধ-অশ্রু বন্যার মত সব ভাসাইয়া দিল। মানদাকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গিয়া বলিল, গুণীদা কি চিঠি লিখে দিয়েছে, আমাকে দে।

মানদা কহিল, তিনি ত চিঠি দেননি!

হেম যেন বিশ্বাস করিতে পারিল না, বলিল, দেননি?

মানদা বলিল, না দিদিমণি! তিনি কি উঠতে পারেন যে, চিঠি লিখবেন!

হেম পাংশু হইয়া গিয়া বলিল, উঠতে পারেন না, কি হয়েছে তাঁর?

তুমি কিচ্ছু জান না?

না, বল।

মানদা বলিল, আর কি বলব? বলিয়াই কাঁদিতে লাগিল।

হেম রূক্ষভাবে বলিল, কাঁদিস পরে—এখন বল্‌।

সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, বলবার কিছুই নেই দিদি। তুমি চলে আসার পরের দিনই আবার জ্বরে পড়েন, ভাল হন, আবার জ্বরে পড়েন, আবার ভাল হন,আবার জ্বরে পড়েন—ফিরে গিয়ে যে দেখতে পাব, এমন ভরসাও করিনে।

হেম বলিল, তার পরে বল্‌।

মানদা বলিল,তার পরে কোথায় বর্ধমান না কোথা থেকে খবর পেয়ে,কোথাকার মাসী আসে,তার পরে মেসো, তার পরে মাসতুতো ভাই,বৌ,বোন,ভগিনীপতি,এখন আর কেউ বাকী নেই। বাড়িতে আর জায়গা নেই।

আমি সব বিদেয় করব—তার পর?

খাচ্ছে, দাচ্ছে, বসে আছে। বাবু ওপরে পড়ে আছেন, না ডাক্তার, না বদ্যি, না ওষুধ, না পথ্যি! শুনি, হাওয়া বদলালে ভাল হয়, তা নিয়ে যায় কে?

হেম বলিল, তোরা কি কচ্ছিস? নন্দা নিয়ে যায়নি কেন?

মানদা কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, সে-ই বাবুর অনেকদিনের চাকর, তাকে মেসোবাবুর ছেলে অভয় মেরে তাড়িয়ে দিয়েচে—ছোঁড়া আবার মদ খায়—এক-একদিন বাড়িতে এসে এমন হাঙ্গামা করে যে, ভয়ে কেউ বেরুতে পারে না—তাকে আমাদের বাবু পর্যন্ত ভয় করেন।

হেম ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, মানু, একটা কথা সত্যি বল দিদি, আমার গুণীদা কি তাহলে বাঁচবে না?

মানদা বলিল, কেন বাঁচবেন না দিদি, দেখালে শোনালে, চেষ্টা করলে নিশ্চয় ভাল হবেন—কিন্তু অমন করে ফেলে রাখলে আর ক'দিন?

হেম মিনিট-খানেক চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, মানদা, তোদের ফিরে যাবার টাকা আছে?

আছে বৈ কি দিদি! জানোই ত, বাবু এক টাকার দরকার থাকলে সঙ্গে দশ টাকা দিয়ে পাঠান—আমাদের ভাড়া আমার কাছেই আছে। বলিয়া সে আঁচলে বাঁধা নোট দেখাইল।

হেম জিজ্ঞাসা করিল, কবে যাবি? কাল?

মানদা বলিল, হাঁ দিদি, কালই যেতে হবে—আমি যা একটা লোক আছি, না হলে সবাই নতুন—কেউ টিকতে পারে না। যেমন মাসী, তেমনি মেসো, তেমনি ছেলে, তেমনি ঝি-বৌ—বিধাতা-পুরুষ যেন ফরমাশ দিয়ে এঁদের এক ছাঁচে ঢেলেছিলেন। আমার নাকি বড় শক্ত প্রাণ, তাই এখনও টিঁকে আছি—অভয় ছোঁড়া আমাকেই একদিন তেড়ে মারতে এসেছিল—বাবুকে বলে, ও মলেই বাঁচা যায়!