চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
ডিহরীর বাটীতে পৌঁছিয়া অচলা সেই মোটা খামখানি বাহির করিয়া বলিল, এই তার উইল। মহিম হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল। তাহার মনে পড়িল, ইহার মধ্যে সুরেশের চিঠি আছে। পত্রে কোন্ অচিন্তনীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে, কোন্ দুর্গম রহস্যের পথের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে, তদ্দণ্ডেই জানিবার জন্য মনের মধ্যে তাহার ঝড় বহিতে লাগিল, কিন্তু এই প্রচণ্ড ইচ্ছাকে সে শান্তমুখে দমন করিয়া কাগজখানি পকেটে রাখিয়া দিল।
অচলা কহিল, তুমি কি আজই ডিহরী থেকে চলে যাবে?
হাঁ, এখানে থাকবার আর আমার সুবিধা হবে না।
আমাকে কি চিরকাল এখানেই থাকতে হবে?
মহিম একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তুমি কি আর কোথাও যেতে চাও?
অচলা কহিল, কাল থেকেই আমি তাই কেবল ভাবচি। শুনেচি, বিলেত অঞ্চলে আমার মত হতভাগিনীদের জন্যে আশ্রম আছে, সেখানে কি হয় আমি জানিনে, কিন্তু এদেশে কি তেমন কিছু,— বলিতে বলিতেই তাহার বড় বড় চোখ—দুটি জলে টলটল করিতে লাগিল। এই প্রথম তাহার চক্ষে অশ্রু দেখা দিল।
মহিমের বুকে করুণার তীর বিঁধিল, কিন্তু সে কেবল ধীরে ধীরে উত্তর দিল, আমিও জানিনে, তবে খোঁজ নিতে পারি।
কখনো তোমাকে চিঠি লিখলে কি তুমি জবাব দেবে না?
প্রয়োজন থাকলে দিতে পারি। কিন্তু আমার গুছিয়ে নিয়ে বার হতে দেরি হবে—আমি চললুম।
অচলা তাহার শেষ দুঃখকে আজ মনে মনে স্বামীর পায়ে নিঃশেষে নিবেদন করিয়া দিয়া সেইখানেই মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল এবং তিনি বাহির হইয়া গেলে চৌকাঠ ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পথে চলিতে চলিতে মহিম ভাবিতেছিল, রামবাবুর বাটীতে আর একমুহূর্তও থাকা চলে না, অথচ শহরের মধ্যে আর কোথাও একটা দিনের জন্য আশ্রয় লওয়া অসম্ভব। যেমন করিয়াই হোক, এ দেশ হইতে আজ তাহাকে বাহির হইতে হইবে, তা ছাড়া নিজের জন্য তাহার এমন একটা নিরালা জায়গার প্রয়োজন, যেখানে দু’দণ্ড স্থির হইয়া বসিয়া শুধু কেবল খামখানার ভিতর কি আছে, তাই নয়, আপনাকে আপনি চোখ মেলিয়া দেখিবার একটুখানি অবসর মিলিবে।
অচলাকে তিল তিল করিয়া ভালবাসিবার প্রথম ইতিহাস তাহার কাছে অস্পষ্ট, কিন্তু এই মেয়েটিকেই কেন্দ্র করিয়া তাহার জীবনের উপর দিয়া যাহা বহিয়া গিয়াছে, তাহা যেমন প্রলয়ের মত অসীম, তেমনি উপমাবিহীন। আবার নিঃশব্দ সহিষ্ণুতার শক্তিও বিধাতা তাহাকে হিসাব করিয়া দেন নাই। তাহার গৃহ যখন বাহির এবং ভিতর হইতে জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে ঐখানে দাঁড়াইয়াই ভস্মসাৎ হইল—এতটুকু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সংসারে ছড়াইতে পাইল না। কিন্তু আজ তাহার শক্তির ডাক কেবল সহিবার জন্য পড়ে নাই—সামঞ্জস্য করিবার জন্য পড়িয়াছে। আজ একবার তাহার জমা-খরচের খাতাখানা না মিলাইয়া দেখিলে আর চলিবে না। কোথাও একটু নির্জন স্থান আজ তাহার চাই-ই চাই।