এই ওয়েবসাইটটি সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখতে হলে Mozilla Firefox, Microsoft Edge অথবা Apple Safari browser ব্যবহার করুন।

উপন্যাস  :  বিরাজবউ         
পরিচ্ছেদ: / 18
পৃষ্ঠা: / 74
ছোটবৌ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, এ আর ক্ষমা কি দিদি? বিনা অপরাধে এত দণ্ড দিয়েও তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হ’ল না—তিনি তোমাকেও নিতে বসেচেন। একটা হাত নিলেন, চোখ নিলেন , তবুও যদি তোমাকে আমাদের কাছে ফেলে রেখে দিতেন—

বিরাজ হাসিয়া উঠিল। বলিল, কি করতিস আমাকে নিয়ে? পাড়ায় দুর্নাম রটেচে—আমার বেঁচে থাকায় আর ত লাভ নেই বোন।

ছোটবৌ গলায় জোর দিয়া বলিয়া উঠিল, আছে দিদি, তা ছাড়া ও ত মিথ্যে দুর্নাম—ওতে আমরা ভয় করিনে।

তোরা করিস নে, আমি করি। দুর্নাম মিথ্যে নয়, খুব সত্যি। আমার অপরাধ যতটুকুই হয়ে থাক ছোটবৌ, তার পরে আর হিঁদুর ঘরের মেয়ের বাঁচা চলে না। তোরা ভগবানের দয়া নেই বলচিস, কিন্তু—

তাহার কথাটা শেষ হইবার পূর্বেই পুঁটি উচ্ছ্বসিত কান্নার সুরে চেঁচাইয়া উঠিল, ওঃ ভারী দয়া ভগবানের!

এতক্ষণ সে চুপ করিয়া কাঁদিতেছিল আর শুনিতেছিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া অমন করিয়া উঠিল। কাঁদিয়া বলিল, তাঁর এতটুকু দয়া নেই, এতটুকু বিচার নেই। যারা আসল পাপী, তাদের কিছু হল না, আর আমাদের তিনি এমনই করে শাস্তি দিচ্চেন।

তাহার কান্নার দিকে চাহিয়া বিরাজ নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল। কি মধুর, কি বুকভাঙ্গা হাসি! তারপরে কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে বলিল, চুপ কর্‌ পোড়ারমুখী, চেঁচাস্‌ নে।

পুঁটি ছুটিয়া আসিয়া তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, তুমি ম’রো না বৌদি, আমরা কেউ সইতে পারব না। তুমি ওষুধ খাও—আর কোথাও চল—তোমার দুটি পায়ে পড়ি বৌদি, আর দুটো দিন বাঁচ।

তাহার কান্নার শব্দে আহ্নিক ফেলিয়া নীলাম্বর ত্রস্তপদে কাছে আসিয়া শুনিতে লাগিল, পুঁটির যা মুখে আসিল, সে তাই বলিয়া ক্রমাগত অনুনয় করিতে লাগিল। এইবার বিরাজের দুই চোখ বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িল। ছোটবৌ সযত্নে তাহা মুছাইয়া দিয়া পুঁটিকে টানিয়া লইতেই, সে তাহার বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া সকলকে কাঁদাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল। বহুক্ষণ পরে বিরাজ অবনত ভগ্নকন্ঠে বলিতে লাগিল, কাঁদিস নে পুঁটি, শোন্‌।

নীলাম্বর আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল, বিরাজের চৈতন্য সম্পূর্ণ ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার যন্ত্রণার অবসান হইয়াছে তাহা সে বুঝিল। বিরাজ বলিতে লাগিল, না বুঝে তাঁর দোষ দিস না পুঁটি। কি সূক্ষ্ম বিচার, তবু যে কত দয়া, সে কথা আমার চেয়ে কেউ বেশী জানে না। মরাই আমার বাঁচা, সে কথা আমি গেলেই তোরা বুঝবি। আর বলচিস— একটা হাত আর একটা চোখ নিয়েচেন, সে ত দুদিন আগে পাছে যেতই। কিন্তু এইটুকু শাস্তি দিয়ে তিনি তোদের কোলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েচেন, সেটা কি করে ভুলবি পুঁটি?

ছাই ফিরিয়ে দিয়েচেন, বলিয়া পুঁটি কাঁদিতেই লাগিল।

ভগবানের দয়া বা সূক্ষ্মবিচারের একটা বর্ণও সে বিশ্বাস করিল না। বরং সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে গভীর অত্যাচার ও অবিচার বলিয়াই মনে হইতে লাগিল। খানিক পরে বিরাজ বলিল, পুঁটি, অনেকক্ষণ দেখিনি রে, তোর দাদাকে একবার ডাক্‌।