নিজের চিন্তাশীলতায় নূতন কথা বলবার আমার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নাই, স্বদেশবৎসল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মুখে বহু সভা-সমিতিতে যে-সকল কথা আপনারা বহুবার শুনেছেন, আমি সেই সবই শুধু লিপিবদ্ধ করে এনেছি। ভেবেছি, অভিনবত্ব নাই থাক, মৌলিকত্ব যত বড় হোক, তার চেয়েও বড় সত্য কথা। পুরানো বলে সে তুচ্ছ নয়, তাকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়াও বড় কাজ। তেমনি মাত্র গুটি দুই-তিন কথাই আজ আমি আপনাদের কাছে উল্লেখ করব।
কিছুদিন থেকে একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করে আসছি। ভাবি, এতবড় সত্যটা এতকাল গোপনে ছিল কি করে? সেদিনও সবাই জানত, সবাই মানত—পলিটিক্স জিনিসটা কেবল বুড়োদেরই ইজারা মহল। আবেদন-নিবেদন, মান-অভিমান থেকে শুরু করে চোখ-রাঙ্গানো পর্যন্ত বিদেশী রাজশক্তির সঙ্গে যা-কিছু মোকাবিলার দায়িত্ব, সব তাদের। ছেলেদের এখানে একেবারে প্রবেশ নিষেধ। শুধু অনধিকার-চর্চা নয়, গর্হিত অপরাধ। তারা ইস্কুল-কলেজে যাবে, শান্তশিষ্ট ভাল ছেলে হয়ে পাস করে বাপ-মায়ের মুখোজ্জ্বল করবে—এই ছিল সর্ববাদিসম্মত ছাত্র-জীবনের নীতি। এর যে কোন ব্যত্যয় ঘটতে পারে, এর বিরুদ্ধে যে প্রশ্ন মাত্র উঠতে পারে, এ ছিল যেন লোকের স্বপ্নাতীত। হঠাৎ কোথাকার কোন্ উলটো ঝোড়ো হাওয়ায় এর কেন্দ্রটাকে ঠেলে নিয়ে একেবারে যেন পরিধির বাইরে ফেলে দিলে। বিদ্যুৎ-শিখা যেমন অকস্মাৎ ঘনান্ধকারের বুক চিরে বস্তুর প্রকাশ করে, নৈরাশ্য ও বেদনার অগ্নি-শিখা তেমনি করেই আজ সত্য উদ্ঘাটিত করেছে। যা চোখের অন্তরালে ছিল, তা দৃষ্টির সুমুখে এসে পড়েছে। সমস্ত ভারতবর্ষময় কোথাও আজ সন্দেহের লেশমাত্র নেই যে, এতদিন লোকে যা ভেবে এসেছে তা ভুল, সত্য তাতে ছিল না বলেই বিধাতা বারংবার ব্যর্থতার কালিমা দেশের সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছেন। এ গুরুভার বৃদ্ধদের জন্যে নয়, এ ভার যৌবনের। তাই ত আজ ইস্কুল-কলেজে, নগরে-পল্লীতে, ভারতের প্রত্যেক ঘরে ঘরে যৌবনের ডাক পড়েছে। ডাক বৃদ্ধরা দেয়নি, দিয়েছেন বিধাতাপুরুষ নিজে। তাঁর আহ্বান কানের মধ্যে দিয়ে এদের বুকে পৌঁছেছে যে, জননীর হাতে-পায়ে বাঁধা এই কঠিন শৃঙ্খল ভাঙ্গবার শক্তি অতি প্রাজ্ঞ প্রবীণের হিসাবী বুদ্ধির মধ্যে নেই, এই শক্তি আছে শুধু যৌবনের প্রাণচঞ্চল হৃদয়ের মধ্যে। এই নিঃসংশয় আত্মবিশ্বাসে আজ তাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। এতদিন বিদেশীয় বণিক রাজশক্তির কোন চিন্তাই ছিল না, বৃদ্ধের রাজনীতি চর্চাকে সে খেলাচ্ছলেই গ্রহণ করে এসেছিল, কিন্তু এখন তার আর খেলার অবকাশ নেই। দিকে দিকে এ চিহ্ন কি আপনাদের চোখে পড়েনি? যদি না পড়ে থাকে, চোখ মেলে চেয়ে দেখতে বলি। রাজশক্তি আজ ব্যাকুল এবং অচিরভবিষ্যতে এই অন্ধ-ব্যাকুলতায় দেশ ছেয়ে যাবে—এ সত্যও আজ আপনাদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে বলি। আরও বলি, সেদিন যেন এই সত্যোপলব্ধির অবমাননা না ঘটে।